নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনকারী জুবায়ের হোসেন নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক শিক্ষার্থীকে আটকে পুলিশে দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বুধবার (২৪ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান আব্দুর রাজ্জাক বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় এ মামলা দায়ের করেন।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে বলে দাবি প্রক্টরিয়াল বডির। জুবায়ের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের আইন বিভাগের ছাত্র বলে জানা যায়।
জানা যায়, বুধবার বেলা ১১টায় ক্যাম্পাসে অটোরিকশা ও রিকশা চলাচলের বিকল্প হিসেবে চক্রাকার বাস চালুর দাবিতে মানববন্ধন করেন একদল শিক্ষার্থী। সেখানে জোবাযেরও ছিলেন। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরেই প্রক্টরের গাড়ি এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। এরপর মানববন্ধনে থাকা শিক্ষার্থীদের তাদের দাবির বিষয়টি প্রক্টর কার্যালয়ে গিয়ে জানানোর প্রস্তাব দেন। শিক্ষার্থীরাও এতে রাজি হন। পরে অন্তত ৮ জন শিক্ষার্থী প্রক্টর কার্যালয়ে যান। কিন্তু জোবায়েরকে আটকে রেখে বাকি সবাইকে চলে যেতে বলে সহকারী প্রক্টরেরা। এরপর রাত নয়টার দিকে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
মানববন্ধনে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ডেকে নেওয়ার পর জোবায়েরের বিরুদ্ধে প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরেরা মিথ্যাচার করছে। জোবায়ের এ ধরনের কোনো কাজে জড়িত নন। শুধু ফেসবুকে তার আইডি থেকে বিভিন্ন সময় সরকারের সমালোচনা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে আটক করা হয়েছে। তার কাছ থেকে এ ধরনের বেশ কিছু ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। আর সে নিজেও একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে।
কী ধরনের ডকুমেন্ট জানতে চাইলে রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, শাটলের চালককে অপহরণ করে বটতলী পর্যন্ত কোনো স্টেশনে না থামিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জোবায়ের তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছে। এ ছাড়া ১৫ আগস্ট বাঙালির আনন্দের দিন। এমন কথাও তার ফোন থেকে পাওয়া গেছে। তাই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির জোবায়েরের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার বেশ কিছু প্রমাণাদি তাকে দিয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে তিনি আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।
শিক্ষার্থীরা নানান মতের চর্চা করবে সরকার নীতিবিরোধী কাজ করলে তার প্রতিবাদ করবে এটা তাদের ন্যায্য অধিকার। আমরা দেখলাম সরকারিবিরোধী স্লোগান থাকায় ও কাজের সমালোচনা করায় একজন ছাত্রকে চবি প্রশাসন পুলিশে তুলে দিলো।
এদিকে ওই শিক্ষার্থীকে প্রক্টর অফিসে আটকে রেখে হেনস্তাসহ মামলা দিয়ে পুলিশকে সোপর্দ করার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে চবি ছাত্র ফেডারেশন।
এক বিবৃতিতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চক্রাকারে বাস সার্ভিস চালু, সিএনজিচালক কর্তৃক ছাত্র হেনস্থার বিচারসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলনরত অবস্থায় আন্দোলনকারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে হেনস্তা এবং ‘হটাও মাফিয়া বাঁচাও দেশ’ স্লোগান সম্বলিত ছবি মোবাইলে রাখার অপরাধে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের হোসেনকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়ে হাটহাজারী থানায় সোপর্দ করে চবি প্রশাসন। এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।’
সংগঠনটির নেতা হাসান মঞ্জুর প্রভাত এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থীর মত প্রকাশ করার মৌলিক অধিকার রয়েছে। একই সাথে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত করার অধিকারও শিক্ষার্থীদের আছে। আর সরকারের সমালোচনা মানে রাষ্ট্রদ্রোহী এই চিন্তাটাই সাংঘর্ষিক। রাষ্ট্রপ্রধান বিরোধী হলে রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যায় না। শিক্ষার্থী এবং দেশের নাগরিক হিসেবে সরকারের নীতিবিরোধী কাজের সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু আমরা দেখলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সম্পূর্ণ ইখতেয়ার বহির্ভূতভাবে আন্দোলন করার জন্য শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘসময় আটকে রেখে তাদের হেনস্তা করেছে এবং ফোনে ‘হঠাও হাসিনা বাঁচাও দেশ’ এই লেখা ছবি রাখার কারণে আইন বিভাগের জোবায়ের হোসেন সোহাগকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে। যা সম্পূর্ণ অন্যায়, অসাংবিধানিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর করতে পারে না।’
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চর্চার সূতিকাগার। এখানে শিক্ষার্থীরা নানান মতের চর্চা করবে সরকার নীতিবিরোধী কাজ করলে তার প্রতিবাদ করবে এটা তাদের ন্যায্য অধিকার। আমরা দেখলাম সরকারিবিরোধী স্লোগান থাকায় ও কাজের সমালোচনা করায় একজন ছাত্রকে চবি প্রশাসন পুলিশে তুলে দিলো। আমরা মনে করি, এখানে ওই ছাত্রের নাগরিক অধিকার খর্ব করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন দ্রুত জুবায়ের হোসেনের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছে। একই সাথে আর কোন শিক্ষার্থী যেন প্রশাসন কর্তৃক এমন হেনস্তার শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।’
জুবায়ের সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ সমাবেশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে জুবায়ের সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।
ছাত্র অধিকার কর্মীকে প্রক্টরিয়াল বডির আটকে রাখার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গত ১৩ জুন ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে ছাত্র অধিকারের এক নেতাকে মারধর করে প্রক্টরিয়াল কার্যালয়ে নিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা। মারধরের শিকার ওই কর্মীর নাম তামজিদ হোসেন। তিনি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। তাকেও চার ঘণ্টা আটকে রাখে প্রক্টরিয়াল বডি। আটকে রাখা ও ছাত্রলীগ কর্মীদের হয়রানির শিকার হয়ে তামজিদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট দিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৩
আপনার মতামত জানানঃ