গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ক্রেমলিনের অভিযান শুরুর পর রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর ব্যাংকিং লেনদেনসহ বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর ফলে ঋণপত্র খোলা, পণ্যের চালানের নিশ্চয়তা পাওয়ার মতো বিষয়গুলো ঝুলে ছিল। এর পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার কারণে লেনদেনের ধরন নিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি কৃষ্ণসাগরে জাহাজ চলাচল এখনো নিরাপদ নয়। সম্প্রতি রাশিয়ার কৃষি ও খাদ্যপণ্য আমদানি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে, বিশেষ করে গমের। যার প্রভাব পড়ে দেশের বাজারে। একটা পর্যায়ে এসে যখন বিশ্ববাজারে দাম কমতে শুরু করে, তখন শুরু হয় ডলার নিয়ে অস্থিরতা। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কম থাকলেও স্থানীয় বাজারে খাদ্যশস্যের দাম আরেক দফা বেড়ে যায়।
এসব কারণে এখন ৩৮-৪০ টাকা কেজি দরের প্রতিকেজি খোলা আটা ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। গম ও আটার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে রুটি পাউরুটিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের খরচও বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যখন আটার দাম বাড়ে তখন স্বভাবিকভাবেই অনেক ভোক্তা চালের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়।
গত বোরো মওসুমে কয়েক দফা বন্যা, পাহাড়ি ঢল ও ঝড়ের কারণে যখন চালের উৎপাদন কমে তখন এর প্রভাব পড়ে বাজারে। একইসঙ্গে, চলতি আমন মওসুমে খরার কারণে উৎপাদন ঘাটতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে প্রতি বছর দেড় কোটি টন চাল উৎপাদন হয়।
এই অবস্থায় দেশের বাজারে কেজিতে ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে মোটা চাল, চিকন চাল মানেই ৭০-৭৫ টাকা। আরও একটু ভালো চাল খেতে হলে এখন সেটা কিনতে হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়।
এ কারণে চাল আমদানিতে সরকার বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং দ্রুত চাল আমদানি করতে চাচ্ছে।
রাশিয়াসহ তিনটি পৃথক দেশের সাথে চুক্তির মাধ্যমে ৮.৩ লাখ টন গম ও চাল আমদানি চূড়ান্ত করতে চাইছে বাংলাদেশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বুধবার (২৪ আগস্ট) রাশিয়া ও ভিয়েতনাম সরকারের সঙ্গে দুটি বৈঠক করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠকে রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, ভিয়েতনাম থেকে ২.৩ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
এর আগে খাদ্য মন্ত্রণালয় ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সবগুলো আমদানিই হবে জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) ভিত্তিতে।
আগামী মাসেই রাশিয়ান গমের অন্তত দুটি চালান দেশে আনতে চায় সরকার।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার টিবিএসকে বলেন, ‘সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা এখন দ্রুত চুক্তিপত্র সই করবো। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পর পুনরায় রাশিয়া থেকে গম আমদানি শুরু হতে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, এই মুহুর্তে আমদানির উদ্যোগ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ভুমিকা রাখবে।
সরকার বেসরকারি খাতকে ১০.১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু, ডলারের বাড়তি দামের কারণে মাত্র ৪৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। তাই সরকার এখন চালের ওপর থাকা আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের করতে চাইছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বৃহষ্পতিবার ভারতের আরও একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করবে, এর মাধ্যমে আরও ১ লাখ টন চাল আমদানি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। এর বাইরে আগামী ২৯ তারিখ মিয়ানমারের সঙ্গেও বৈঠকের কথা রয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, খাদ্যশস্য আমদানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা না থাকার কারণেই রাশিয়া থেকে আমদানি করা যাবে। এজন্য সরকার তরিৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করে আমদানি করতে চাচ্ছে।
আগামী মাসেই রাশিয়ান গমের অন্তত দুটি চালান দেশে আনতে চায় সরকার।
বাংলাদেশের গম আমদানির অন্যতম উৎস ছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন। দেশের মোট চাহিদার অন্তত ২৫ ভাগ গম আমদানি হতো এই দুই দেশ থেকে।
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত গতকাল বিকেলে রাশিয়া দূতাবাস আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশের কাছে অপরিশোধিত তেলের পাশাপাশি পরিশোধিত তেল কেনার প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। এ বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ ছয় মাস পূর্তিতে দূতাবাস ওই আলোচনার আয়োজন করে।
বাংলাদেশের কাছে বিক্রির জন্য রাশিয়া ডিজেলের যে নমুনা দিয়েছে, তাতে বিএসটিআই অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি সালফার রয়েছে। রাশিয়ার ডিজেল ডার্টি (নোংরা) জ্বালানি বলে বাংলাদেশকে কম দামে বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কি না, গোলটেবিল আলোচনার পর এই প্রতিবেদকের এ প্রশ্নের জবাবে আলেক্সান্দার মান্টিটস্কি বলেন, জ্বালানি তেল বিক্রির বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। কিন্তু বিষয়টি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।
ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই দেশের নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল–গ্যাস অনুসন্ধানে রাশিয়ার জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিদ্ধান্তটা বাংলাদেশকে নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১০৪৩
আপনার মতামত জানানঃ