জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। দেশটির লাখ লাখ নাগরিক নানা সময়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দাবদাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অনেক অংশ ডুবে যাবে।
এদিকে, ৫০০ বছরে মাত্র একবার দেখা যায়, এমন ভয়াবহ খরার কবলে ইউরোপ; খরতাপে পুড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের মোট প্রদেশগুলির ৪৩ শতাংশ; ‘হর্ন অভ আফ্রিকা’- অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ। একইসময়, ধান উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয়- চীন ও ভারতে প্রধান খাদ্যশস্যটির ফলন নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে বৃষ্টিহীনতা।
এভাবেই ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধ চলাকালে জলবায়ু পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক আপদগুলি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ফেলছে বলে জানান খাদ্য ও রপ্তানিপণ্য প্রস্তুতকারকরা।
তৈরি পোশাক খাত (আরএমজি) বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু, খরার কারণে প্রধান উৎপাদন অঞ্চলে তুলার ফলনও কম হতে পারে। দামও তাতে অনেকটাই বাড়বে। এই দামে আমদানি করলে বাড়বে পোশাক প্রস্তুতের খরচ। এতে দেশ থেকে বিশ্ববাজারে পোশাক পণ্যের রপ্তানিও কমতে পারে।
খাদ্য প্রক্রিয়া ও প্রস্তুতকারক শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব দেশে জলবায়ু সংকটের কারণে খাদ্য উৎপাদন কমবে, তারা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু, সরবরাহই চাহিদার চেয়ে কম হলে– তাতে শস্যের দাম আরও চড়বে নিঃসন্দেহে।
খাদ্য নিয়ে বাংলাদেশকে মহা-মুসিবতে ফেলেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এই সংঘাত সরবরাহ চক্রেও বিচ্ছিন্নতা ঘটায়। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাশিয়া থেকে সার ও গম আমদানি করতে পারেনি বাংলাদেশ। পরবর্তীকালে, প্রতিবেশী ভারতের গম রপ্তানিতে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা– দেশের স্থানীয় বাজারের সরবরাহ সমস্যাকে তীব্র করে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী ও খাদ্য প্রস্তুতকারক বসুন্ধরা গ্রুপের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যেই নাজুক অবস্থানে (খাদ্যের) বৈশ্বিক সরবরাহের পরিস্থিতি। তার ওপর আবার খরায় যদি কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়–তাতে মারাত্মক এক বৈশ্বিক সংকট দেখা দিবে–যার চাপ এসে পড়বে আমাদের ওপর’।
নাম না প্রকাশের শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেন বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় গম উৎপাদক। কিন্তু, যুদ্ধের কারণে সেখানে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রেই একটি বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
আরেকটি প্রধান উৎপাদন অঞ্চল– আর্জেন্টিনাও পড়েছে খরার কবলে, এতে সেখানে গমের উৎপাদন কমবে– যা বিশ্ববাজারে সরবরাহ ঘাটতিকে তীব্র করে তুলতে পারে।
১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াল খরা চলছে আর্জেন্টিনায়–অথচ লাতিন আমেরিকার দেশটি থেকে সয়াবিন ও গম আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ ভারত থেকে চাল আমদানির চেষ্টা করছে । কিন্তু, বৃষ্টিপাতের অভাবে ভারতে ধান উৎপাদনের প্রধান কয়েকটি রাজ্যে চারা রোপণ হয়েছে আগের তুলনায় কম জমিতে। আমদানিকারকরা বলছেন, ফলন কম হলে– স্থানীয় বাজারে মূল্য স্থিতিশীল রাখতে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে প্রতিবেশী দেশটি। এতে বাংলাদেশ সমস্যায় পড়বে।
অতীতের সব রেকর্ড ভাঙ্গা তাপপ্রবাহ এবং প্রচণ্ড খরায় ঝলসে যাচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধান উৎপাদক- চীন। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশটির মধ্য ও দক্ষিণপশ্চিমের কিছু অংশে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোর চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে স্বস্তি নেই তুলা নিয়েও। বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল থেকে তুলা আমদানি করে। খরায় এ মৌসুমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২২৯ মিলিয়ন একর জমির তুলা ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের একটি প্রাক্কলন জানাচ্ছে, খরার কারণে হওয়া ফসলহানিতে এরমধ্যেই প্রায় ২৫ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে মার্কিন অর্থনীতির।
জলবায়ু সংকটের এই প্রভাবে ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই তুলার উৎপাদনে বড় পতনের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের আমদানি কমবে, একইসাথে বাড়বে আমদানি মূল্য।
বাংলাদেশের সুতা প্রস্তুতকারক, বস্ত্রকল ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী সমিতি- বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)- এর অতিরিক্ত পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত) মনসুর আহমেদ-ও এমনটাই মনে করছেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘তুলা আমদানিতে বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচটি উৎস দেশের একটি হলো- ব্রাজিল। কিন্তু, সেখানেও খরার কারণে তুলা উৎপাদন কমলে–বাংলাদেশের ওপর প্রচণ্ড আঘাত আসবে’।
এনভয় টেক্সটাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান কুতুবুদ্দিন আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন কমলে (তুলার) দাম অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। ‘এতে আমাদের উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে; কারণ, আমেরিকার উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববাজারে তুলার দামের সূচকগুলি ওঠানামা করে’।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের খরা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ইইউ-এর ৪৭ শতাংশ এলাকায় খরা সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ১৭ শতাংশ অঞ্চলে জারি হয়েছে- চরম খরার লাল সংকেত। এতে ২০০৭ সালের পর ইইউ-ভুক্ত দেশগুলিতে ভুট্টার উৎপাদন সবচেয়ে কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরোপজুড়ে মাংস ও ডেইরি পণ্যের দামও বেড়েই চলেছে।
জার্মানির প্রধান নদী রাইনের পানি এতটাই কমেছে যে, নাব্যতার অভাবে সেখানে নৌযানকে আগের তুলনায় ৭৫ শতাংশ কম মালামাল বহন করতে হচ্ছে। রাইন জার্মানির অন্যতম প্রধান পণ্য পরিবহন পথ হওয়ায়– মহাবিপদে রয়েছে দেশটি।
চরমতম খরার কবলে পুড়ছে ফ্রান্সও। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, পরমাণু চুল্লি ঠাণ্ডা রাখার পানির অভাবে দেশটির শক্তি উৎপাদক কোম্পানি- ইলেকট্রিসিটে ডি ফ্রঁসকে তাদের পরিচালিত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমাতে হয়েছে। অথচ ফ্রান্সের ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করে পরমাণু বিদ্যুৎ।
বৃষ্টির অভাবে ফ্রান্স এতটাই শুস্ক হয়ে উঠেছে যে, দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল ভয়াবহ দাবানলেও পুড়ছে। এরমধ্যেই প্রাণ বাঁচাতে বসতবাড়ি ছাড়তে হয়েছে হাজারো অধিবাসীকে। পানি স্বল্পতার কারণে– কৃষকদের জমি সেচের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
ফ্রান্সে ভুট্টার ফলন এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম হতে চলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গম, পিচ, স্ট্রবেরি, অ্যাপ্রিকট, আঙুরসহ অন্যান্য ফসল।
ইতালির প্রধানতম পো নদীর পানি ৯০ শতাংশের মতো কমেছে। তাতে ব্যাহত হয়েছে ভুট্টা ও রিসোত্তো চালের উৎপাদন। মিঠাপানির প্রবাহ না থাকায় নদীটির মোহনা দিয়ে সাগরের নোনাজল উজানের দিকে রেকর্ড মাত্রায় উঠে এসেছে।
চলতি বছরের খরায় রিসোত্তো চালের উৎপাদন ৬০ শতাংশ কম হতে পারে। কিন্তু, লবণপানির আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ধানক্ষেতে উৎপাদন স্বাভাবিকে ফিরতে অনেক বছর সময় লাগবে।
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও শুস্ক আবহাওয়ায় তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পঙ্গপালের আক্রমণ হয়েছে ইতালির সার্ডিনিয়া দ্বীপ। সেখানে শীতকালীন খাদ্য মজুদ ও প্রাণিসম্পদের সমূহ ক্ষতি করেছে এই উৎপাত। সবমিলিয়ে, ইতালির এক-তৃতীয়াংশ খামারকে এখন লোকসান দিয়ে খাদ্য উৎপাদন করতে হচ্ছে।
বর্ষাকালে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অভাব লক্ষ করছে বাংলাদেশ। এতে জুলাই-আগস্টের আমন ধান রোপণের সময়ে পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে কৃষকের।
ডিজেল আরও দামি হয়ে ওঠায়–পাম্পের বাড়তি খরচ যোগ হবে খাদ্যের উৎপাদন মূল্যে। বৃষ্টির অভাবে, ফলনও উল্লেখযোগ্যহারে কমতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, যেকোনো উপায়ে দেশে খাদ্য উৎপাদনের স্বাভাবিক পরিমাণ ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন কৃষি-অর্থনীতিবিদেরা। এজন্য সরকারের প্রতি নীতি সংশোধনের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
কৃষি-অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বৈশ্বিক এ পরিস্থিতিতে, আমাদের ফসল উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে–একইসঙ্গে ফলন বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকতে হবে । সেচের জন্য সরকারের উচিত কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া’।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২২
আপনার মতামত জানানঃ