এক শিশুকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার চাচাতো ভাই। তাই ধর্ষণচেষ্টার মামলা এক সপ্তাহেও নেয়নি পুলিশ। উল্টো মেয়ের বাবাকে পুলিশের মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত শিবালয় থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আরিফ হোসেনকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ধর্ষণচেষ্টার মামলা নেয় পুলিশ।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মেয়েকে (৫) ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মানিকগঞ্জের শিবালয় থানায় এক সপ্তাহ আগে লিখিত অভিযোগ করেন বাবা। এক সপ্তাহ পরও মামলা না হওয়ায় গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় থানায় যান ভুক্তভোগী বাবা। তবে মামলা না নিয়ে উল্টো পুলিশ তাকে মারধর করে থানা থেকে বের করে দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগী শিশুর স্বজনদের অভিযোগ, শিশুটিকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার চাচাতো ভাই। মামলা না করার জন্য আওয়ামী লীগের ওই নেতা শিশুটির পরিবারকে ভয়ভীতি দেখান। পরবর্তীকালে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার এক সপ্তাহ পরও পুলিশ তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেনি।
পুলিশ, ভুক্তভোগী শিশুটির পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভুক্তভোগী ওই শিশুর মা–বাবা ঢাকায় থাকেন। এই দম্পতির পাঁচ বছরের মেয়ে উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে দাদির কাছে থাকে। গত ২০ জুলাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. মান্নান খানের চাচাতো ভাই রজ্জব খান বাড়িতে গিয়ে শিশুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এ ঘটনা দেখে ফেলেন শিশুটির দাদি।
পরে গ্রামের মাতবরদের বিষয়টি জানানো হয়। তবে অভিযুক্ত রজ্জব প্রভাবশালী হওয়ায় গ্রামের মাতবরেরা কোনো পদক্ষেপ নেননি। মান্নান খান ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে শিশুটির পরিবারকে ভয়ভীতি দেখান। এরপর ১৪ আগস্ট এ ঘটনায় শিবালয় থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন শিশুটির বাবা। কিন্তু সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও থানা থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় অভিযোগের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে মা ও মেয়েকে নিয়ে শিশুটির বাবা থানায় যান। এ সময় ওসি থানায় ছিলেন না।
শিশুটিকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার চাচাতো ভাই। মামলা না করার জন্য আওয়ামী লীগের ওই নেতা শিশুটির পরিবারকে ভয়ভীতি দেখান। পরবর্তীকালে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার এক সপ্তাহ পরও পুলিশ তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেনি।
শিশুটির বাবার ভাষ্য, থানায় যাওয়ার কারণ জানতে এগিয়ে আসেন এএসআই আরিফ হোসেন। এরপর মেয়েকে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা এএসআইকে জানান তিনি। এএসআই আরিফ তার শার্টের কলার ধরে তাকে থানার একটি কক্ষে নিয়ে যান। তার অভিযোগ, এএসআই তখন অভিযুক্ত রজ্জবের ভাই আওয়ামী লীগের নেতা মান্নানকে মুঠোফোনে কল করেন।
ফোনে রেখে তাকে এলোপাতাড়ি কিল, ঘুষি ও লাথি মারা হয়। একপর্যায়ে তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় বাইরে তার মা ও মেয়ে কান্নাকাটি করলেও এএসআই আরিফের হাত থেকে তাকে রক্ষায় থানার কেউ এগিয়ে আসেননি। পরে তাকে থানা থেকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
আসামি রজ্জব খান পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ভুক্তভোগী শিশুর পরিবারকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে আজ রোববার দুপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মান্নান খানের মুঠোফোন নম্বরে সংবাদমাধ্যম থেকে একাধিকবার কল করা হয়। তবে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
এ দিকে মারধর ও মেয়েকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে থানায় মামলা না নেওয়ার বিষয়টি জানাতে গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে মা, মেয়ে ও এক স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যান শিশুটির বাবা। সেখান থেকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (শিবালয় সার্কেল) কার্যালয়ে যান। এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরজাহান লাবণী তাঁদের ঘটনা শুনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
শিবালয় সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরজাহান লাবণী বলেন, ঘটনা জানার পর অভিযুক্ত এএসআই আরিফ হোসেনকে রাতেই থানা থেকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশে সংযুক্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করা হবে। গতকাল শনিবার রাতে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
লিখিত অভিযোগ দেওয়ার এক সপ্তাহ পরও মামলা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহিনের সরকারি মুঠোফোন নম্বরে সংবাদমাধ্যম থেকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনালে ৬ মাসের মধ্যে এসব মামলার বিচার শেষ করার বিধান আছে৷ কিন্তু নানা অজুহাতে তা শেষ হয় না৷ অর্থ ও ক্ষমতার কারণে কিছু অসৎ পুলিশও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে গড়িমসি করে। আবার মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে টালবাহানা করে। কখনো টাকার বিনিময়ে অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দিতে চেষ্টা করে দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ। কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের না দেখার ভান করে।
একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর পুলিশের যথাসময়ে সঠিক ধারায় মামলা গ্রহণ, ধর্ষক ও ধর্ষিতার সঠিক বয়স উল্লেখ, মামলার সুষ্ঠু তদন্ত, চিকিৎসকের নির্ভুল ময়নাতদন্ত, যথাযথ ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের ওপর পুরো বিচার প্রক্রিয়া নির্ভরশীল। এর ভিন্নতা হলে ধর্ষক বিচারে আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কাজেই ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায় অপরাধী যাতে উপযুক্ত শাস্তি পায় এর নিশ্চয়তা বিধান মামলার বিচার সংশ্লিষ্টদের মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৪
আপনার মতামত জানানঃ