সরকারের বাজেট ঘাটতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে।
এক দশক আগে ২০১০ সালে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকায়। ২০২০ সাল শেষে তা বেড়ে হয় ৫ লাখ ২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে অর্থাৎ ২০২১ সালের জুন শেষে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি ছিল ৭ লাখ ২২ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা।
প্রতি বছরই সরকারের বাজেট বড় হচ্ছে। কিন্তু বাজেটের আকারের সঙ্গে সংগতি রেখে রাজস্ব আয় বাড়াতে পারেনি সরকার। ফলে বাজেটের আকার বড় হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়। যদিও এ বাজেটের ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকাই রাখা হয়েছে ঘাটতি বাজেটের খাতায়। দেশের জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশই বর্তমানে ঘাটতি বাজেট। এ ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য বিদেশী উৎসের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও ঋণ নেয় সরকার। এর মধ্যে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি ঋণ নেয়া হয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে। আর পরোক্ষ ঋণ নেয়া হয় ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রির মাধ্যমে।
অর্থ বিভাগের এক নিজস্ব বুলেটিনে জানা যাচ্ছে, সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণ বেড়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। বর্তমানে সরকারের ঋণের স্থিতি রয়েছে ১২ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে জুন সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণস্থিতি ছিল ১১ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে এই পরিমাণ ঋণ বেড়েছে।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরকারের ঋণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩১.৪২ শতাংশ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বা ২০২১ সালের জুন শেষে সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণস্থিতি ছিল ১১ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। এটি ছিল জিডিপির ৩২.৩৮ শতাংশ। এই হিসাবে ৯ মাসের ব্যবধানে সরকারের ঋণস্থিতি বাড়লেও জিডিপির হিসাবে ঋণস্থিতি কমেছে প্রায় ১ শতাংশ। কারণ এবার নতুন ভিত্তি বছর হিসেবে জিডিপির আকার অনেকখানি বেড়েছে বলে ঋণের স্থিতি কমে গেছে।
অর্থ বিভাগ সূত্র মতে, করোনাজনিত কারণে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সার্বিক ঋণস্থিতি বেড়েছে। তবে এটি এখনো ঝুঁকিসীমার অনেক নিচে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘টেকসই ঋণ কাঠামো’ (ডেট সাসটেইনেবল ফ্রেমওয়ার্ক-ডিএসএফ)-এর মানদণ্ড অনুযায়ী, জিডিপির ৫৫ শতাংশ ঋণকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১২ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকেই বেশি ঋণ নিয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি হচ্ছে সাত লাখ ৭৭ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। এটি মোট পুঞ্জীভূত ঋণের ৬২ শতাংশ। আর বৈদেশিক ঋণের স্থিতি হচ্ছে চার লাখ ৭১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। এটি মোট পুঞ্জীভূত ঋণের ৩৮ শতাংশ।
গত ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে অর্থাৎ ২০২১ সালের জুন শেষে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ছিল সাত লাখ ২২ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি ছিল চার লাখ ২০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে অর্থাৎ ২০২১ সালের জুন শেষে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ছিল সাত লাখ ২২ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি ছিল চার লাখ ২০ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা।
সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে গৃহীত ঋণের তুলনায় ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সরকার অধিক পরিমাণ ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে গৃহীত সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ৬৪ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ চার লাখ ১২ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে গৃহীত পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ হচ্ছে তিন লাখ ৬২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ বলছে, সঞ্চয়পত্র খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রম এ খাতে সরকারের ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে আনবে। একইভাবে অভ্যন্তরীণ ফিন্যানশিয়াল মার্কেটেরও সংস্কার প্রয়োজন।
অন্যদিকে বৈদেশিক চার লাখ ৭১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা ঋণস্থিতির মধ্যে পুঞ্জীভূত বহুপাক্ষিক ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ৮৮ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা (৬১ শতাংশ)। আর দ্বিপক্ষীয় ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৮৩ হাজার ২০৭ কোটি টাকা (৩৯ শতাংশ)।
অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান ‘মধ্য মেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল’ আরো আধুনিকায়ন করা হবে। পাশাপাশি আংকটাডের কারিগরি সহায়তায় অর্থ বিভাগে ‘ডেট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিসিস সিস্টেম’ নামে একটি কাস্টমাইজ ডাটাবেইস স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া সরকারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঋণ পরিস্থিতি আলোচনা ও বিশ্লেষণ, ঋণগ্রহণের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণে চলতি বছরের শেষ দিকে একটি ‘ঋণ সম্মেলন’-এর আয়োজন করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণেই সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঘাটতি বাজেটের আকার যত বড় হবে সরকারের ঋণও তত বাড়বে। এ মুহূর্তে বাজেটের অন্যতম বড় ব্যয়ের খাত হয়ে উঠেছে ঋণের সুদ পরিশোধ। বিদ্যমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। দিনশেষে জনগণকেই সরকারের এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ