বাংলাদেশের প্রায় দুই লাখ নারী সৌদি আরবে কাজ করেন। সৌদির আশপাশের বিভিন্ন দেশ জর্ডান, ওমান বা লেবাননেও নারীশ্রমিকরা রয়েছেন। এসব শ্রমিকের অনেকেই ফিমেইল ডিপোর্টেশন সেন্টার বা বিভিন্ন সেইফহোমে অবস্থান করছেন। চাকরি হারিয়ে তারা এসব কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বাংলাদেশে ফেরার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করছেন। করোনাভাইরাসের কারণে গত এপ্রিল মাস থেকে দফায় দফায় লকডাউন ও কারফিউ দেয় সৌদি আরব। এসময় বিমান চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় ফিমেল ডিপোর্টেশন সেন্টার ও সেইফ হোমে আশ্রয় নেওয়া নারীশ্রমিকরা দেশে ফিরতে পারেনি। সম্প্রতি বিমান চলাচল কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার পর তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু যখনই তারা দেশে ফিরতে শুরু করলেন তখনই নিয়ম করা হলো নন-কোভিড সার্টিফিকেট না থাকলে তারা দেশে ফিরতে পারবেন না।
এ নিয়ম মানতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন সৌদি আরবের বিভিন্ন সেফ হোমে থাকা বাংলাদেশী নারী কর্মীরা। কারণ অবৈধ হয়ে পড়ায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় করোনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না তারা। আবার বেসরকারি ব্যবস্থায় করোনা পরীক্ষার সামর্থ্যও তাদের নেই। এ অবস্থায় আশ্রয় নেয়া নারী কর্মীদের দেশে পাঠাতে পিসিআর টেস্টের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাস।
৩ ডিসেম্বর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে দেয়া ওই চিঠিতে দূতাবাস অনুরোধ জানিয়ে বলেছে, পিসিআর টেস্টের পরিবর্তে দূতাবাস থেকে দেয়া প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে তাত্ক্ষণিকভাবে শুধু শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করে তাদের আকাশপথে ভ্রমণের সুযোগ দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি সৌদি কর্তৃপক্ষ সেফ হোমে থাকা নারী কর্মীদের দেশে ফেরতের প্রক্রিয়া সহজ করতে দূতাবাসের সহযোগিতা চেয়েছে। সেফ হোমে থাকা গৃহকর্মীরা দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে উড়োজাহাজে ওঠার আগে এক মাসেরও বেশি সময় (ক্ষেত্রবিশেষে তিন-ছয় মাস) ফিমেল ডিপোর্টেশন সেন্টার ও দূতাবাসের সেফ হোমে অবস্থান করেন। এ সময়ে তারা নভেল করোনাভাইরাসমুক্ত কিনা, সে বিষয়ে যথাযথভাবে মেডিকেল চেকআপ করা হয়। এখানে তারা প্রকৃতপক্ষে কোয়ারেন্টিন ও যথাযথ পরিচ্ছন্ন পরিবেশে অবস্থান করেন। এ কারণে ফ্লাইটে ওঠার আগে তাদের পিসিআর পরীক্ষার প্রয়োজন আছে মর্মে প্রতীয়মান হয় না। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে তাদের পিসিআর টেস্ট করার জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দও নেই।
বাংলাদেশ দূতাবাস আরও জানায়, এসব বাংলাদেশি নারীর কোনো কাগজপত্র নেই। এ কারণে সৌদি সরকার নারীশ্রমিকদের সে দেশের সরকারি হাসপাতাল থেকে পিসিআর পরীক্ষা করতে অপারগতা জানিয়েছে। সৌদি আরবের বেসরকারি ক্লিনিক থেকে তাদের পিসিআর পরীক্ষার জন্য এক থেকে দুই হাজার সৌদি রিয়াল প্রয়োজন, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪৬ হাজার টাকা। এত টাকা পরিশোধ করার সামর্থ্য এসব গৃহকর্মীর নেই। এ বিষয়ে সরকারি কোনো বরাদ্দও নেই।
সৌদি আরবস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব দেওয়ার পর তারা গত ৬ ডিসেম্বর প্রস্তাবটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জানায়নি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মনিরুছ সালেহীন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ নারীশ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, বিদেশে কর্মরত নারীশ্রমিকদের যদি কভিড টেস্ট করাতে হয় সেই খরচ অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারকে বহন করতে হবে। আমাদের এসব শ্রমিক যাওয়ার সময় কল্যাণ ফান্ডে যে টাকা দিয়েছে, নিয়মিত রেমিট্যান্সে পাঠিয়ে যে উপকার করেছেএরপর কভিড টেস্টের খরচ শ্রমিকের নিকট থেকে নেওয়া উচিত নয়। কল্যাণ ফান্ডের টাকা থেকে এই টেস্ট করতে হবে। দেশে ফিরিয়ে আনার পর আইসোলেশনে মর্যাদার সঙ্গে তাদের রাখা উচিত।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে নারী শ্রমিক রফতানি হয়েছে মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৫৭৮। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে যান ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ জন ; এর মধ্যে সৌদি গিয়েছিলেন ৭৩ হাজার ৭১৩ জন। আর চলতি বছর (২০২০) সৌদি আরবে গিয়েছেন ১০ হাজার ৯৩০ জন নারী কর্মী।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য বলছে, গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত কারাভোগ শেষে আউটপাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী কর্মী ফেরত এসেছেন সৌদি আরব থেকে। এর মধ্যে নারী কর্মীই ফেরত এসেছেন ১৭ হাজার ৩১৬ জন।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৬১৩
আপনার মতামত জানানঃ