পৃথিবীর প্রতিটি দেশ বিভিন্ন দিক থেকে একে অপরের থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। শুধু আবহাওয়ার দিকটাই বিবেচনা করা হোক। আফ্রিকায় যেখানে তীব্র গরম আবহাওয়া বিরাজ করে, সেখানে এ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ প্রায় পুরোটা বছর অতি শীতল আবহাওয়া দেখতে পাওয়া যায়। এ্যান্টার্কটিকায় তীব্র উষ্ণতায় বরফ সব গলে গিয়েছে, এটা যেমন অকল্পনীয়, ঠিক তেমনই আফ্রিকায় তুষারপাত হচ্ছে, এটাও অকল্পনীয়।
জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে আফ্রিকা মহাদেশ পৃথিবীর অন্য সব মহাদেশ থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছে। সেই উপনিবেশিক সময় থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য উৎসুক জীববিজ্ঞানী এই মহাদেশে পেশাগত কাজে পা রাখেন।
অনেক বিশেষজ্ঞ এই পুরো মহাদেশটিকে একটি ‘বিশাল চিড়িয়াখানা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ ও এক হাজারেরও বেশি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী পাওয়া গেছে। পৃথিবীতে যত স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে, তার একটি বিশাল অংশ রয়েছে আফ্রিকায়। এসব প্রাণীর খাদ্যাভাস, চলন কিংবা বেঁচে থাকার কৌশল বেশ চমকপ্রদ।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাফারি পার্কগুলো প্রায় সবই আফ্রিকায় অবস্থিত। এই সাফারি পার্কগুলোতে বিভিন্ন প্রাণী দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। শুধু তাই নয়, এমন বেশ কিছু সাফারি পার্ক রয়েছে যেগুলোতে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে।
আফ্রিকার সাফারি পার্কগুলোতে যারা ভ্রমণে যান, তাদের সেখানে গমন করার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ‘দ্য গ্রেট আফ্রিকান মাইগ্রেশন’। আফ্রিকার বিশাল জীববৈচিত্র্যের মাঝে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে এই ঘটনাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। ইতিহাসে স্তন্যপায়ী পশুদের যত অভিবাসন হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিবাসন হচ্ছে এটি।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, মানুষ যেমন বিভিন্ন কারণে (পেশা, চিকিৎসা, ভ্রমণ কিংবা পড়াশোনা) এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমায়, ঠিক সেভাবেই আফ্রিকার বেশ কিছু সাফারি পার্ক মূলত খাদ্য সংগ্রহের জন্য বেশ কিছু প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী গড়ে আটশো কিলোমিটার বিপদসংকুল পথ পাড়ি দেয়। এজন্যই এটাকে ‘অভিবাসন’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায়ই তাদেরকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে আসতে হয়। মূলত সেরেঙ্গাতি ন্যাশনাল পার্ক থেকে জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, হরিণ ইত্যাদি প্রাণী ঘাসের জন্য বছরের নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা শুরু করে, যে যাত্রায় তাদের শেষ গন্তব্যস্থল থাকে মাসাই মারা।
প্রতি কিলোমিটারে গড়ে এক হাজার ওয়াইল্ডবিস্ট, হরিণ ও জেব্রা হেঁটে যাচ্ছে খাবারের সন্ধানে– এইধরনের দৃশ্যের সন্ধান পৃথিবীর খুব জায়গায় পাওয়া সম্ভব নয়। কথিত আছে, লাখ লাখ প্রাণীর এমন অভিবাসনের দৃশ্য নাকি সুদূর মহাকাশ থেকেও দেখা যায়। জীববিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগেও সেরেঙ্গাতি ন্যাশনাল পার্কের এই অভিবাসনের পথ ও জীববৈচিত্র্য যেভাবে ছিল, এখনও সেভাবেই অপরিবর্তিত আছে।
পুরো অভিবাসনে মোট কতগুলো স্তন্যপায়ী প্রাণী অংশ নেয়, সেই সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তারপরও ধারণা করা হয়, সব মিলিয়ে প্রায় বিশ লাখের কাছাকাছি প্রাণী এই অভিবাসনে অংশগ্রহণ করে। বলে রাখা ভালো, সেরেঙ্গাতি ন্যাশনাল পার্ক অবস্থিত তাঞ্জানিয়ায়, অপরদিকে মাসাই মারা ন্যাশনাল পার্ক অবস্থিত কেনিয়ায়। অর্থাৎ, অভিবাসনে অংশগ্রহণকারী প্রানীগুলোকে তাঞ্জানিয়া থেকে কেনিয়াতে যেতে হয়। সেই সাথে এই যাত্রায় পদে পদে মৃত্যুর ফাঁদ পাতা থাকে।
“কেন জেব্রা, হরিণ কিংবা ওয়াইল্ডবিস্টের মতো পশু শত শত মাইল পাড়ি দেয়?”– এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘খাদ্য’। মূলত জানুয়ারি থেকে মার্চ–এই তিন মাস ওয়াইল্ডবিস্টের বংশ বিস্তারের সময়। এই তিন মাসে নতুন জন্ম নেয়া বাচ্চাসহ পূর্বের ওয়াইল্ডবিস্টদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়, ফলে দক্ষিণ সেরেঙ্গাতির সমতলভূমির উপর যে ঘাস রয়েছে, তার উপর চাপ বেড়ে যায় অনেক গুণ। এক সময় ঘাস ফুরিয়ে আসে, ওয়াইল্ডবিস্টদের ঘাসের বিকল্প অনুসন্ধান করতে হয়। এর ফলে তারা দক্ষিণ সেরেঙ্গাতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
এই ওয়াইল্ডবিস্ট ও অন্যান্য প্রাণীদের এক অংশ ঘাসের উপরের অংশ ভক্ষণ করে, আরেক অংশ ভক্ষণ করে ঘাসের মধ্যম অংশ। এই দুই ভাগের প্রাণীদের ভক্ষণ শেষ করার পর যে অংশটুকু থাকে, সেটি আবার প্রাণীদের আরেক অংশ ভক্ষণ করে থাকে। একেবারে যখন আর ঘাস পাওয়া যায় না, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণীরা সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এভাবেই তারা শেষ পর্যন্ত প্রায় আটশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফেলে।
প্রকৃতির একটি অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে ‘সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’। এই নীতি অনুযায়ী যেসব প্রাণী পরবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না, তারা ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে হাঁটা দিবে। ‘দ্য গ্রেট আফ্রিকান মাইগ্রেশন’ এর ক্ষেত্রেও আমরা এই মূলনীতির প্রতিফলন দেখতে পাই। পূর্ণবয়স্ক ওয়াইল্ডবিস্টগুলোর সাথে জানুয়ারিতে বা ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নেয়া ওয়াইল্ডবিস্ট শাবকগুলোকেও এই অভিবাসন অভিযানে অংশগ্রহণ করতে হয়। এই প্রাণীগুলোর অভিবাসন প্রক্রিয়া চিতাবাঘ, হায়েনা কিংবা সিংহের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য রীতিমতো আশীর্বাদ বয়ে আনে। এই সময়ে অভিবাসন অভিযানের আশেপাশেই তারা ঘোরাফেরা করে এবং সুযোগ বুঝে শিকার হাতিয়ে নেয়।
শুধু তাই নয়, দীর্ঘ এই অভিবাসন অভিযানে প্রাণীদেরকে ‘গ্রুমেতি’ নামের একটি নদী পাড়ি দিতে হয়। এই নদীতে কুখ্যাত ‘নাইল ক্রোকোডাইল’ অপেক্ষায় থাকে, কখন এই প্রাণীগুলো নদী পার হবে। যেসব ওয়াইল্ডবিস্ট, হরিণ কিংবা জেব্রা শারীরিকভাবে দুর্বল থাকে, তারা অনেক সময় এই খরস্রোতা নদীতে ডুবে মারা যায়। প্রায় তিন লাখ প্রাণী হয় সিংহ কিংবা হায়েনার হাতে নয়তো নদীতে ডুবে কিংবা কুখ্যাত ‘নাইল ক্রোকোডাইল’ এর হাতে মারা পড়ে। তূলনামূলক কমবয়সী প্রাণীগুলো বেশি করে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
সেরেঙ্গাতি ন্যাশনাল পার্কের এই প্রাণীগুলোর অভিবাসনের ঘটনা চলমান থাকে পুরো বছর। সাধারণত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে প্রাণীগুলো যাত্রা শুরু করে৷ ‘ওয়েস্টার্ন করিডোর’-এ পৌছতে তাদের সময় লাগে মার্চ মাস পর্যন্ত৷ এরপর জুন কিংবা জুলাই মাসে তারা গ্রুমেতি নদী পার হয়। জুলাই মাসের শেষ দিকে তারা কেনিয়ার মাসাই মারা ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশ করে। আবার নভেম্বর মাসের দিকে তারা সেরেঙ্গাতি ন্যাশনাল পার্কের দক্ষিণাঞ্চলে ফিরে আসে।
জীববৈচিত্র্যের আধার আফ্রিকায় হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা ‘দ্য গ্রেট আফ্রিকান মাইগ্রেশন’ পৃথিবীর পশুপ্রেমীদের জন্য একটি দুর্দান্ত দৃষ্টিনন্দন ঘটনা। সেরেঙ্গাতি ন্যাশনাল পার্কে যে পরিমাণ পর্যটকের আগমন ঘটে, তার সিংহভাগই আসে ‘দ্য গ্রেট আফ্রিকান মাইগ্রেশন’ এর সময়ে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা কিংবা ‘সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্বের বাস্তবিক প্রয়োগ এই ঘটনাকে স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ