ক্ষমতার দীর্ঘ ১৩ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদ, বিভিন্ন বক্তৃতা এবং গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাত নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি এবং এসব মন্তব্য নিয়ে অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানাধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মন্তব্য নিয়ে আমাদের পর্যালোচনা।
“গ্যাস উত্তোলনে যত বাধাই আসুক, দেশের উন্নয়নে সরকার যা করা দরকার তা-ই করবে।”
[সংসদ অধিবেশনে বক্তৃতাকালে। ৭ অক্টোবর ২০০৯, বিডিনিউজ২৪ ডটকম]
পর্যালোচনা: শেখ হাসিনার এই ঘোষণার পর এক যুগেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তার সরকার গ্যাস উত্তোলনে কোনো অর্জন দেখাতে পারেনি। এমনকি সমুদ্রজয় নিয়ে বহু বড়াই করেছে, কিন্তু সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলনেও নেই কোনো অগ্রগতি। উল্টো বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানির পথে হেঁটে জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করে তুলেছে। গ্যাস উত্তোলনে তাদের সামনে কোনো বাধাই ছিল না। বরং বিশেষজ্ঞরা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের কাজ ত্বরান্বিত করতে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার নিজেই গ্যাস উত্তোলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ শেষ অবধি তারা মনে করেছে, গ্যাস উত্তোলন না করে জ্বালানি আমদানি করলে তা থেকে আয় রোজগারের সুবিধা বেশি। জ্বালানি খাতে শেখ হাসিনার সরকার দেশের উন্নয়ন নয় বরং নিজেদের লোকজনের পকেটের উন্নয়নকেই বরাবর অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসকে করে তুলেছেন ব্যয়বহুল।
“বিদ্যুৎ ও পানির বাস্তবে যত সংকট রয়েছে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তা আরও প্রকট করে তোলা হচ্ছে৷ ওয়াসা ও ডেসার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া হবে।”
[ঢাকায় বিজয় স্মরণী-তেজগাঁও সংযোগ সড়কের উদ্বোধনকালে। ২০ এপ্রিল ২০১০, ডয়েচে ভেলে বাংলা]
পর্যালোচনা: বিদ্যুৎ ও পানির ক্ষেত্রে আজো সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। কৃত্রিম সংকটের অভিযোগ করে শেখ হাসিনা অন্যের কাঁধে দোষ চাপাতে চাইলেও বরং দীর্ঘ কাল পরিক্রমায় এটাই প্রমাণ হয়েছে যে, সরকারের নীতিগত অবস্থানের কারণেই বিদ্যুৎ ও পানির সংকট প্রলম্বিত হচ্ছে। ঢাকা শহরে ওয়াসার পানি পানের উপযোগী নয়, এ নিয়ে সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপও নেই। বিদ্যুৎ খাতকে স্বনির্ভর ও সাশ্রয়ী করার পথেও হাঁটেনি সরকার। ফলে পানি ও বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি আরো বেড়েছে। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়ার তো কোনো নমুনাই নেই, বরং বছর বছর তাদের মেয়াদ বাড়িয়ে আরো দুর্নীতি চালানোর সুযোগ করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা নিজেই। বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি ঠেকাতে কেউ যেন আদালতে যেতে না পারে, সেজন্য প্রণয়ন করেছেন কুখ্যাত দায়মুক্তি আইন।
“যারা এখন দেশপ্রেমের কথা বলছেন, দেশের কোনো সংকটেই তাদের পাওয়া যায় না৷ আমার চেয়ে কে বেশি দেশপ্রেমিক? আমার চেয়ে দেশের স্বার্থ নিয়ে কে বেশি চিন্তা করে? আপনারা দায়িত্ব নেন, আমরা কারো সঙ্গে চুক্তি করব না।“
[তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কনকো ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা প্রসঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ডের সদর দপ্তরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে। ১৯ জুন ২০১১, ডয়েচে ভেলে বাংলা]
পর্যালোচনা: কনকো ফিলিপসের সঙ্গে করা ওই চুক্তি ছিল শেখ হাসিনার অদূরদর্শীতারই প্রমাণ। পরবর্তীকালে প্রমাণ হয় যে, কোম্পানিটি বাংলাদেশে এসেছিল, সে সময় শেয়ার বাজারে চলা তাদের দুরবস্থা ঘোঁচাতে। কার্যত বাংলাদেশের সময়ক্ষেপণ করে তারা টাকা নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো অগ্রগতিই তাদের দ্বারা ঘটেনি। শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করে চুক্তি করলে কনোকো ফিলিপসকে এ ধরনের কাজের জন্য জবাবদিহি তো করতেই হতো, এমনকি জরিমানাও দিতে হতো। শেখ হাসিনার দেশবিরোধী পদক্ষেপের কারণেই অভ্যন্তরীণ গ্যাস উত্তোলন কর্মসূচি বাতিলের খাতায় চলে গেছে এবং গ্যাস সংকট আজ চরম রূপ ধারণ করেছে।
“আমাকে গ্যাস বিক্রির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি বলে ২০০১ সালের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র, ‘র’, আইএসআই সব এক হয়ে গিয়েছিল। গ্যাস বিক্রি করিনি বলে আমরা ক্ষমতায়ও আসতে পারিনি।”
[গণভবনে কুমিল্লা জেলার তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায়। ১০ মার্চ ২০১২, দৈনিক যুগান্তর]
পর্যালোচনা: শেখ হাসিনা তখন এটা উল্লেখ করেননি যে, এই দফায় তিনি কী মুচলেকা দিয়েছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরোধীদের জেলে পুরে রেখে তাকে নির্বাচনে বিরাট জয় পেতে সাহায্য করেছিল। তবে এটা এখন পরিষ্কার যে, শেখ হাসিনা সরকার জ্বালানি খাতকে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল করে গড়ে তুলেছেন। আইএমএফের দেয়া শর্তের অধীনে বিদ্যুৎ খাতকে সংস্কার করেছেন। রাশিয়া ও চীনকে সেখানে ভাগ দিয়েছেন। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানির জন্য ভারতীয় কোম্পানিগুলোর কাছে বিদ্যুৎ খাতকে বর্গা দিয়েছেন। বক্তৃতাকালে খুব জাতীয় স্বার্থপন্থী সাজলেও বাস্তবে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে আমদানি ও বিদেশনির্ভর করে গড়ে তুলেই ক্ষমতার মসনদকে স্থায়ী করেছেন।
“লোডশেডিংয়ের দরকারও আছে। মানুষ যাতে ভুলে না যায়, লোডশেডিং নামে কিছু একটা ছিল।”
[জাতীয় সংসদে বক্তৃতাকালে। ৩০ মার্চ ২০১২, প্রথম আলো]
পর্যালোচনা: শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী, তার সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো জনগণের শান্তি ও বিকাশ নিশ্চিত করা, এটা করবেন বলেই তিনি শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার দর্পে এরকম ঔদ্ধত্য তিনি বারবারই প্রকাশ করেছেন। যেন জনগণকে তিনি শিক্ষা দিতে চান। এক হাত দেখে নিতে চান। এরকমই তার মনোভঙ্গি। কিন্তু তিনি আর সব স্বৈরশাসকের মতোই ইতিহাসের পাঠ স্মরণে রাখেননি। যে কারণে আজ আবার লোডশেডিং বুমেরাং হয়ে তার দিকে ফেরত এসেছে। এখন তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে পার পেতে চাইছেন। এমনকি চিপায় পড়ে ভদ্রলোকও বনে যাচ্ছেন- বলছেন, বিরোধীরা যদি লোডশেডিং-এর জন্য তার কার্যালয় ঘেরাও করতে আসে, তাহলে তাদের চা-নাস্তা খাওয়াবেন, তাদের কথা শুনবেন।
“রামপালের জন্য এই আন্দোলন কেন, সেটা ভেবে দেখা দরকার। বিরোধিতার উদ্দেশ্য কী, তা বের করা দরকার। যারা রামপাল নিয়ে চেঁচামেচি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে; তাদের বলছি, রামপালের জন্য সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। দেশের ক্ষতি করে কোনো কাজ শেখ হাসিনা করবে না।”
[ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি উদ্বোধন ও রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে। ০৫ অক্টোবর ২০১৩, বিডিনিউজ২৪ ডটকম]
পর্যালোচনা: শেখ হাসিনার ডাহা মিথ্যাগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। তিনি বরাবরই জাতীয় স্বার্থ প্রসঙ্গে বড় গলায় জোর দিয়ে মিথ্যাচার করেছেন, প্রমাণ করেছেন চোরের সর্দারের বড় গলা। বাগেরহাটের রামপালে এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে শেখ হাসিনার এসব মিথ্যাচার বিশেষজ্ঞরা কখনোই মেনে নেয়নি। আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা শেখ হাসিনাকে উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। ইউনেস্কো সরকারকে চাপ দিয়েছে, সুন্দরবন এলাকার ক্ষেত্রে কার্যকরী আইনগুলো পরিবেশসম্মত কিনা তা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন দেয়ার জন্য। সুন্দরবন এলাকায় এই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হুজুগে গড়ে উঠছে নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান। পরিবেশবিদরা বলেছেন, বনের কাছে মানুষের যাতায়াত ও অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি বনের সর্বনাশ ডেকে আনবে। শেখ হাসিনা এসব অভিযোগের যথাযথ তদন্ত ব্যাহত করতে আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবনা উস্কে দিয়ে জনগণের একাংশকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। আসল সত্য হলো, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে সুন্দরবনের ওপর ভারতীয় মালিকানাকে আরো শক্তিশালী করেছে শেখ হাসিনার সরকার।
“বাপেক্সকে আরো শক্তিশালী করা হবে। এর জন্য প্রয়াজনীয় যা সহায়তা লাগবে, তা আমরা করব। বিএনপির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল না, তাই দেশ পিছিয়ে যাচ্ছিল। ২০০৯ এর পর ২০১৪ সালেও জনগণ আমাদেরকে নির্বাচিত করায় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি।”
[হবিগঞ্জের বিবিয়ানায় কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধনকালে। ২৯ নভেম্বর ২০১৪, বিডিনিউজ২৪ ডটকম]
পর্যালোচনা: বাপেক্সকে শেখ হাসিনাই অকার্যকর করেছেন। আগের ধারাবাহিকতায় তার প্রথম আমল পর্যন্তও বাপেক্স সক্রিয় ছিল এবং কম খরচে একের পর এক গ্যাসক্ষেত্রের কাজ এগিয়ে নিয়েছে, কূপ খনন করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা তার দ্বিতীয় আমল অর্থাৎ ২০১৪ সালের পর থেকে বাপেক্সকে ক্রমাগত শক্তিহীন করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। ঠিক সেই সময়েই তিনি এমন দাবি করেন যে, বাপেক্সকে শক্তিশালী করার জন্য যা যা লাগে করবেন। কার্যত এগুলো ছিল ভাঁওতাবাজি। ২০১৪ সালে অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা ভোটে জেতার যে নির্বাচন তিনি আয়োজন করেছিলেন, তা কেউ মেনে নেয়নি। তবু শেখ হাসিনা দাবি করেন যে, জনগণ নাকি তাকে নির্বাচিত করেছেন। কার্যত সে সময় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা এরকম নানা ধরনের ইতিবাচক বয়ান দিয়ে নিজেকে দেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছিলেন। কিন্তু কাল পরিক্রমায় প্রমাণ হয়েছে যে, শেখ হাসিনা পরিকল্পিতভাবে জ্বালানি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তিশালী সংস্থাগুলোর শক্তি ও অধিকার খর্ব করেছেন বিদেশিদের পরামর্শে ও তাদের স্বার্থ রক্ষাকল্পে।
“দিনাজপুরে কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, তৃতীয়টার কাজ চলছে। এলাকার কোনো ক্ষতি হয়নি বরং জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়লার একটা কার্গো ডুবে যাওয়ার পর অনেকে বলল যে পানি নাকি দূষিত হয়ে গেছে। ফিল্টারে পানি পরিশোধনে কয়লা ব্যবহার হয়। অন্যদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহার করা হয়।”
[কেরানীগঞ্জে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্বোধনকালে। ১০ এপ্রিল ২০১৬, প্রথম আলো]
পর্যালোচনা: শেখ হাসিনার অন্যতম হাস্যকর ও উদ্ভট মন্তব্যগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। কোন কয়লায় পানি পরিশোধন হয় আর কোন কয়লায় পানি দূষিত হয়, এই পার্থক্যটি না জেনেই তিনি এ বিষয়ে মানুষকে সবক দিতে নেমে পড়েন। পাথুরে কয়লা ও চারকোলকে একই মনে করে গুলিয়ে ফেলেছেন তিনি। প্রথমটি পাওয়া যায় খনিতে, আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় কাঠ পুড়িয়ে। প্রথমটি সরাসরি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই, বিষাক্ত। এর থেকে চুঁইয়ে পড়া পানিও জৈবযৌগ ও জমির জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে চারকোল বা কাঠ কয়লা ব্যবহার হয় প্রসাধনীসহ নানা কাজে। শেখ হাসিনা এই দুইয়ের তফাত তো বুঝতেই পারেননি, উপরন্তু মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই নিয়েও। উল্লেখ্য, পরিবেশবিদরা বিশেষভাবে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ এটি সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে পড়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনি নির্গত ছাই উঁড়ে বনের মধ্যে চলে যাবে এবং গাছপালার পাতায় ও গাছের শ্বাসমূলের গোড়ায় পড়বে। এতে করে বনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শেখ হাসিনা গলার জোরে তা উলটে দিতে চেয়েছেন এই মন্তব্যের মাধ্যমে।
“আমরা বিদেশ থেকে এলপিজি আমদানির পর বোতলজাত করে ভারতে রপ্তানি করব। আমরা ত্রিপুরায় যে গ্যাস দিচ্ছি সেটি এলপিজি। আমাদের দেশে যেমন সরবরাহ করছি সেটিই ত্রিপুরায় দিচ্ছি।”
[ভারত সফরে গ্যাস রপ্তানির দেশবিরোধী চুক্তি প্রসঙ্গে সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনকালে। ০৯ অক্টোবর ২০১৯, সংবাদ সংস্থা ইউএনবি]
পর্যালোচনা: শেখ হাসিনার এই ভারত সফরকালেই দেশবিরোধী চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় বুয়েট ছাত্র আবরারকে ছাত্রলীগের কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করে। দেশে ফিরে শেখ হাসিনা গ্যাস রপ্তানির পক্ষে সাফাই গাইলেও চুক্তির ভেতরে আর কী কী রয়েছে তা পরিষ্কার করেননি। বাংলাদেশেই এলপিজির দাম ওঠানামা করে নিয়মিত। শেখ হাসিনার সরকার বসুন্ধরাসহ বড় বড় এলপিজি ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে এই খাতে সরকারি উৎপাদনকে ব্যাহত করে রেখেছে। যে কারণে সরকারি এলপিজি বাজারে পাওয়া যায় না। বেসরকারি কোম্পানিগুলো মানুষকে জিম্মি করে এলপিজির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এক বছর অন্তর মূল্যবৃদ্ধির বিধান থাকলেও এলপিজি খাতে প্রতি মাসে মূল্য সমন্বয়ের নীতি চালু করা হয়েছে বেসরকারি এলপিজি উদ্যোক্তাদের মুনাফার জন্য। সরকার যখন দেশের অভ্যন্তরের এলপিজির চাহিদা মেটাতে পারে না, যে কারণে এর দাম প্রায়ই ওঠানামা করে, সে অবস্থায় ভারতে এলপিজি রপ্তানির কোনো সুযোগ নেই। ভারতে এলপিজি রপ্তানি করে দেশের লাভ হওয়ার কথা শেখ হাসিনা দাবি করলেও, ইতোপূর্বে ট্রানজিটসহ নানা খাতে জনগণ দেখেছে যে, ভারতের সঙ্গে চুক্তিগুলোতে ফাঁকফোকর থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ভারতই তাতে লাভবান হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতার মসনদকে আরো স্থায়ী করতেই ভারতে এলপিজি রপ্তানির পথে হেঁটেছেন।
“তাদের সবার হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেন। আমি দেখেছি আমাদের বিএনপি নেতারা হারিকেন নিয়ে আন্দোলন করছে। তো তাদের হাতে হারিকেনই ধরিয়ে দিতে হবে।”
[লোডশেডিং-এর বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে কৃষক লীগের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে। ০১ আগস্ট ২০২২, প্রথম আলো]
পর্যালোচনা: ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ, এবং লোডশেডিং-কে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা দেয়া নেত্রী অবশেষে লোডশেডিংকেই যখন জ্বালানি সংকটের সমাধান গণ্য করলেন, তখন সারা দেশজুড়েই হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা সুস্পষ্ট করেই বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের দেশবিরোধী পরিকল্পিত নীতিই বিদ্যুৎ খাতকে আজ এ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে বিদ্যুৎ ছাড়াই বন্ধ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১১ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে দেয়া হয়েছে পছন্দের কোম্পানিগুলোর হাতে। দেশে গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ রেখে বিদেশের জ্বালানির ওপর দেশকে জোরপূর্বক নির্ভরশীল করা হয়েছে। এভাবে জ্বালানি নিরাপত্তাকে বিদেশে দাম ওঠা-নামার ওপর নির্ভরশীল করে রেখেছে শেখ হাসিনা সরকার। যার ফলাফল হলো আজকের এই জ্বালানি সংকট ও লোডশেডিং। বিদ্যুৎ খাতে এই লুটপাট ও লোডশেডিং-এর বিরুদ্ধে যখন বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছে, শেখ হাসিনার পুলিশ তখন তাদের ওপর গুলি ছুঁড়েছে। ৩১ জুলাই ২০২২ ভোলায় বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে পুলিশ দলের নেতা আবদুর রহিমকে হত্যা করে। ঠিক তার পরের দিনই শেখ হাসিনা পুলিশ ও আওয়ামী লীগকে উজ্জীবিত করতে আন্দোলনকারীদের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেয়ার কথা বলেন। অথচ তার উচিত ছিল লোডোশেডিং-এর জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা। তিনি হয়তো ক্ষমতার দর্পে ভুলে গিয়েছেন যে, পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগও এভাবেই পূর্ব বাংলার মানুষের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেয়ার কথা বলেছিল। পরবর্তীকালে তাদের সেই দম্ভের অবসান হয়েছে নজিরবিহীন পতনের মধ্য দিয়ে।
আপনার মতামত জানানঃ