আধুনিক যুগেও ইরানে নারী ও কন্যাশিশুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত। জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বৈষম্যের শিকার ইরানের নারীরা।
পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর নারীবিদ্বেষী আচরণে জর্জরিত ইরানের নারীদের নিত্যদিনের জীবন। বৈষম্যমূলক আইনের কারণে দিনদিন পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলছে দেশটিতে।
ইরানে সম্প্রতি ৩ জন নারীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তারা তিনজনই তাদের স্বামীদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে, অথবা অত্যাচারের শিকার হওয়ার কারণে নারীরা তাদের স্বামীদের হত্যা করছেন।
তারা আরও বলছেন, ইরানের প্রচলিত আইনগুলো নারী বিদ্বেষী হওয়ায় তারা তালাক নিতে পারেন না। এমনকি পারিবারিক সহিংসতা এবং নির্যাতনের ক্ষেত্রেও তাদের চুপ থাকতে হয়। ফলে বাড়ছে হত্যার মত ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ইরানিয়ান মানবাধিকার সংগঠন আব্দর রহমান বোরোমান্ড সেন্টারের হিসেবে, খুন হওয়া তিন নারী ছাড়াও আরও ছয় নারীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে বছরের প্রথম ছয় মাসে।
এটা সত্যি যে মৃত্যুদণ্ড যাদের দেয়া হয়, তাদের বড় অংশই পুরুষ। কিন্তু এই নয় নারী সেই সংখ্যাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আব্দর রহমান বোরোমান্ড সেন্টারের নির্বাহি পরিচালক রয়া বোরোমান্ড ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২২ বছরে কমপক্ষে ২৩৩ জন নারীর মৃত্যুদণ্ডের তথ্য পেয়েছি।
ইরানের আইনে চাইলেই নারীরা দেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন না। এমনকি নির্যাতনের শিকার হলেও নারীরা বিচ্ছেদ চাইতে পারেন না। গত বছর অক্টোবরে নরওয়ে ভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটস (আইএইচআর) এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ১৬৪ নারীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। আইএইচআরের হিসেবে এ বছরই ইরানে কমপক্ষে ৩০৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এর একটি ক্ষুদ্র অংশকে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে বলেও মনে করা হয়।
বোরোমান্ড বলছেন, যে মাত্র পনের শতাংশ ক্ষেত্রে ঘটনাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। বাকীটা অন্য রাজনৈতিক বন্দী কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা যায়।
দেশটির আইনি প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করতে পারে না। আর একমাত্র ভিকটিমের পরিবার পারে কাউকে ক্ষমা করতে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ইরানের অধিকার কর্মী আতেনা দায়েমি শেষ মূহুর্তে একজন নারীর জন্য চেষ্টা করেছিলেন যাকে সম্প্রতি স্বামী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ৪০ বছর বয়স্ক আফগান এই নারীর নাম সানুবার জালালি।
দায়েমি আশাবাদী ছিলেন যে ওই নারীর স্বামীর পরিবারের সাথে ক্ষমার বিষয়ে তিনি মধ্যস্ততা করতে পারবেন।
দায়েমি বিবিসিকে বলেন, আমরা খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ কোন সহায়তা করেনি। তারা শুধু রাষ্ট্র মনোনীত আইনজীবীর ফোন নাম্বার দিয়েছিলো কিন্তু তিনি আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেন।
কারা কর্তৃপক্ষ অনেকে এসব বিষয়ে কখনো কখনো সহায়তা করে। তবে সবসময় এটি হয় না।
বোরোমান্ড বলছেন যে তিনি দুজনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে আর আটজনকে অঙ্গহানি থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
জালালিকে যেদিন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, সেদিনই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো আরও দুজন নারীকে। এর মধ্যে একজন পনের বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। আর একজনকে পাঁচ বছর আগে তার স্বামীকে হত্যার দায়ে আটক করা হয়েছিলো।
আদালতে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা বলেছেন যে তারা খুন করেছেন বা সহায়তা করেছেন। কিন্তু তারা সবাই এটাও বলেছেন যে সহিংসতার বিরুদ্ধে তাদের কেউ সহায়তা করলে হয়তো তারা অপরাধ সংঘটন করতেন না।
অধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করার অপরাধে দায়েমিকে সাত বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছিলো। তিনি বলছেন যে নারীরা বন্দি থাকার সময় মৌলিক সুবিধা কম পান এবং অনেক সময় তাদের প্রহার করা হয়।
কোর্ট প্রসিডিংসও অনেক সময় নারীর বিরুদ্ধে থাকে কারণ বিচারক ও আইনজীবীরা প্রায় সবাই পুরুষ।
ইরানের আদালতে আসামিকে একজন আইনজীবী দেয়া হয়। তবে তারা খুব একটা আইনি সহায়তা দেন না বলে বলছেন দায়েমি।
তিনি বলেন, এসব আইনজীবীদের প্রায় সবাই হয় সাবেক বিচারক বা কৌসুলি।
তার মতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা এখানে সহজ বিষয় নয়।
নারী বিদ্বেষী প্রক্রিয়া
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের সাংবাদিক আসিয়ে আমিনি এখন নরওয়েতে বাস করেন। তিনি নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এমন কিছু মামলা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
তার মতে, দেশটির আইনি কাঠামোই সমস্যার মূল কারণ।
বিবিসিকে আমিনি বলেন, আইন অনুযায়ী বাবা বা দাদা পরিবারের প্রধান। তারাই বিয়েসহ নারীদের যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
এর মানে হলো এই নারীকে জোর করা হতে পারে বা তিনি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হতে পারেন। আর ইরানের আদালত থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ পাওয়া বলতে গেলে অসম্ভব।
যেসব নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, প্রায়শই তারা অভিভাবকের সমর্থন হারান। কারণ অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন থাকেন ‘পরিবারের সম্মান’ নিয়ে।
এই অবস্থায় কিছু নারী সহিংসতার শিকার হতেই থাকেন, বলছিলেন আমিনি।
আর কিছু ক্ষেত্রে নারীরা তখন স্বামীদের হত্যার চিন্তা করেন।
আদালতে অনেক ক্ষেত্রে নারীরা বলেছেন যে তারা খুন করেছেন বা সহায়তা করেছেন। কিন্তু তারা সবাই এটাও বলেছেন যে সহিংসতার বিরুদ্ধে তাদের কেউ সহায়তা করলে হয়তো তারা অপরাধ সংঘটন করতেন না।
১৬ বছর বয়সী একটি মেয়ে কয়েকজন পুরুষ কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন।
বিচার পাওয়ার পরিবর্তে এই কিশোরীর বিরুদ্ধে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের অভিযোগ আনা হয়।
কয়েকজন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক হয়েছে এটি স্বীকারের পর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আসলে ওই ব্যক্তিরা তাকে ধর্ষণ করেছিলো।
আইন অনুযায়ী, কোন অবিবাহিত ব্যক্তি বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক করলে তার দণ্ড বা বেত্রাঘাতের বিধান আছে। আর এটি তিনবার কেউ করলে তার মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে।
অথচ এই কিশোরীর ক্ষেত্রে তাও অনুসরণ করা হয়নি। তাকে দুবার বেত্রাঘাত করা হয়েছে এবং এর পরের বার তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
চতুর্থবারের সময় বিচারক নিজেই ওই কিশোরীর গলায় রশি পরিয়ে দেন।
মৃত্যুদণ্ড বিরোধী অধিকার কর্মী নারগেজ মোহাম্মদী একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন যেখানে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা দিয়েছিলেন । সেখানে দণ্ড প্রাপ্ত নারীর পুত্র তার মায়ের মৃত্যুদন্ডের সময় পায়ের নীচে থাকা টুল লাথি দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
আসলে ‘পরিবারের সম্মানের’ কথা বলে এটি করতে তার ওপর প্রবল চাপ তৈরি করা হয়েছিলো বলেই মনে করেন তিনি।
আমিনি মনে করেন আইন, আদালত ও প্রথাই নারীকে অপরাধী বানায় ও অপরাধের শিকার করে।
যদিও বোরোমান্ড বলছিলেন ভিন্ন কথা।
তিনি বলেন, ইরানের কারাগারগুলো ভর্তি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা। আর জেলের চাপ কমাতে অনেক সময় খুনের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ তৈরি করা হয় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে যে তারা ক্ষমা করবেন নাকি মৃত্যুদণ্ড দিতে চান। আর এ কারণেই বেশি মানুষকে ফাঁসির দিকে যেতে হয়।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ইরানের নারীরা এখন অত্যন্ত নির্যাতিত এবং ইসলামের নামে নির্যাতিত৷ সেই নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়া হয়তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়৷ বাড়ির বাইরে অর্থাৎ পথে-ঘাটে, মেয়েদের বোরখা বা নেকাব পরা বাধ্যতামূলক৷ কিন্তু কখনো যদি কোন মেয়ের মাথার একটু চুলও কোনভাবে বের হয়ে যায়, তবে তাকে মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়৷ এমন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকতে না পেরে অনেকেই নিজ দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইরান ছেড়ে চলে গেছেন৷ কিন্তু সবার তো সেই সুযোগ বা সাধ্য নেই৷ তারা বাস করছেন এক ভয়াবহ চাপের মধ্যে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৯
আপনার মতামত জানানঃ