সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলাপে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দাবি জানিয়েছে যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ, সিভিল প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বের বাইরে রাখতে হবে।
প্রায় ১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তারপরও বর্তমান সরকারের অধীনে কর্মরত পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনের কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অধীনে নির্বাচনে যেতে ভয় পাচ্ছে দলটি। সে ভয় থেকেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বের বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছে।
তবে দলটি শুধু আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রশাসনে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নির্বাচনী দায়িত্বে রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে আওয়ামী নিয়ন্ত্রিত ইসির অধীনে ন্যস্ত করাসহ ১৪ দফা লিখিত প্রস্তাব করেছে ক্ষমতাসীন দলটি।
দাবি জানিয়েই অন্যান্য দলের মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকছেন না ক্ষমতাসীন দলটি। ইতোমধ্যেই আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনী মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার হেতুতে দলটি কাছা মেরে মাঠে নেমেছে। তারই অংশ হিসাবে দেশের ৪০ জেলায় নতুন পুলিশ সুপারকে (এসপি) দায়িত্ব দিয়েছে আওয়ামী নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে একসঙ্গে ৪০ জেলার নতুন এসপি নিয়োগের ঘটনা এবারই প্রথম।
বুধবার (৩ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে তাদের এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব জেলার আগের এসপিদের নতুন কর্মস্থলে পাঠানো হয়েছে।
সেই ৪০ জেলা হচ্ছে পাবনা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, ময়মনসিংহ, শরীয়তপুর, সুনামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, রাঙামাটি, লালমনিরহাট, নওগাঁ, কক্সবাজার, নেত্রকোণা, বরিশাল, কুমিল্লা, গাজীপুর, পটুয়াখালী, মুন্সিগঞ্জ, শেরপুর, জয়পুরহাট, ফেনী, ঢাকা, বান্দরবান, বরগুলা, ফরিদপুর, খাগড়াছড়ি, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, মাগুরা, ঝালকাঠি, নীলফামারী, নাটোর।
এর আগে গত ১৩ জুলাই অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) পদে ব্যাপক রদবদল করা হয়। তখন ১৩৯ জন অতিরিক্ত ডিআইজি পদে রদবদল হয়। এর মধ্যে এসপি থেকে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া ১১৬ জন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়। তখন থেকেই জেলার এসপি পদেও ব্যাপক রদবদল হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় ছিল।
গত ১৪ বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ পুলিশ-প্রশাসন নিজেদের করায়ত্ব করার পরও সরকারের অধীনে কর্মরত পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনের কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অধীনে নির্বাচনে যেতে ভয় পাচ্ছে, যা খুবই হাস্যকর! বিএনপি আমলের পুলিশ প্রশাসনে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হয় তবে তারচেয়ে বেশি সন্দেহ থাকার কথা আওয়ামী আমলের প্রশাসনে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটি বিএনপি আমলের প্রশাসন বাদ দেওয়ার দাবি জানালেও নিজেদের প্রশাসন রাখার পক্ষে দাবি জানিয়েছেন। এতেই স্পষ্ট হয় যে আসন্ন নির্বাচন আসলে নির্বাচনের নামে প্রহসন হতে যাচ্ছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত বিধানাবলি অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিন সময়কালের মধ্যে সংসদ বহাল থাকাবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী প্রণীত বিধানাবলির আলোকে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকলেও, অতীত অভিজ্ঞতা ধারণা দেয় যে, ক্ষমতাসীনদের অধীন গঠিত নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীনদের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিরপেক্ষতার ছাপ রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে কখনো সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি।
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনী মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার হেতুতে দলটি কাছা মেরে মাঠে নেমেছে। তারই অংশ হিসাবে দেশের ৪০ জেলায় নতুন পুলিশ সুপারকে (এসপি) দায়িত্ব দিয়েছে আওয়ামী নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে একসঙ্গে ৪০ জেলার নতুন এসপি নিয়োগের ঘটনা এবারই প্রথম।
সরকার অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে আমলাতন্ত্রকে তার নিজের পক্ষে নিতে সক্ষম হয়েছে। জনসমর্থনহীন অবস্থায়ও রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোকে শক্তির ভিত্তি এবং একমাত্র অবলম্বন হিসাবে নিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কখনও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এবং হওয়া সম্ভবও না। ঐ যে তারা ক্ষমতায় উঠলে আর নামতে চায় না। সেজন্য তারা অনৈতিক এবং অবৈধ বিভিন্ন পথ বেছে নেয়। সেজন্যই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৪০টি জেলায় পুলিশ সুপার বদলির হিড়িক লাগিয়েছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া আছে সংশ্লিষ্ট আইনে। নির্বাচনের সময় প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর ওপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ থাকার বিধান রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোরও সর্বাত্মক সহোযোগিতা করার কথা বলা আছে। কিন্তু দলীয় সরকারের সময়ে কমিশনের ক্ষমতা কাগজে কলমেই রয়ে যায়।
রাজনৈতিক সরকারের সময় গঠিত হয় দূর্বল নির্বাচন কমিশন। সেকারণে নির্বাচন কমিশনও ভূমিকা রাখতে পারে না।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উপর্যুপরি রুগ্ন চিত্রের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশসহ জাতিসংঘ এবং বিশ্বের স্বনামধন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো হতাশ। আগামী সংসদ নির্বাচন যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশে সমসুযোগ সম্বলিত মাঠে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, সে বিষয়ে ইতোমধ্যে বর্ণিত দেশ ও সংস্থাগুলো তাদের অবস্থান সরকারের কাছে ব্যক্ত করেছে। পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর মধ্যে বিশেষত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন অনিয়ম, কারচুপি ও কালিমায় ভরপুর থাকায় এবং উভয় নির্বাচন সংবিধান ও আইনের ব্যত্যয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ায়, আগামী সংসদ নির্বাচন উল্লিখিত রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর ব্যক্ত অবস্থানের কারণে সংসদ বহাল থাকাবস্থায় দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে কঠিক বাধার সম্মুখীন।
দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ বাধা থেকে উত্তরণে একমাত্র গ্রহণযোগ্য পন্থা হলো দেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর বিরোধী দলে অবস্থানকালীন নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে যে সুস্পষ্ট চিন্তাচেতনা, ধারণা ও মনোভাব এবং এ বিষয়ে দেশের জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার পরিপূরণে সর্বমহলের কাছে গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন। এর ব্যত্যয়ে ভিন্ন পথে অগ্রসরের প্রয়াস নেয়া হলে তা দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতাকে বিপর্যস্ত করে এক অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ পানে দেশকে ঠেলে দেবে।
নির্বাচন পরিচালনায় দলীয় সরকারের ভূমিকা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে দলগুলোর মধ্যেই যে চরম অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা সহসাই কাটবে কি না, তা এখনই বলা মুশকিল। এছাড়া দলীয় সরকার শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটা দেখাবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৭
আপনার মতামত জানানঃ