যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি গতকাল মঙ্গলবার রাতে তাইপে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে বিতর্কিত তাইওয়ান সফর শুরু করেছেন। তিনি তাইপে পৌঁছানোর পরই তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চল দিয়ে ২১টি চীনা সামরিক বিমান উড়তে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন তাইপের কর্মকর্তারা।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। টুইটারে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) ২১টি সামরিক বিমান গতকাল দিবাগত রাতে (২ আগস্ট) তাইওয়ানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আকাশ প্রতিরক্ষা শনাক্তকরণ অঞ্চলে (এডিআইজেড) প্রবেশ করেছিল।’
তাইওয়ানের এডিআইজেড চীনের দাবিকৃত স্ব-শাসিত এ দ্বীপটির প্রচলিত আকাশসীমা নয়। তাইওয়ানের এডিআইজেড-এ চীনের আকাশ প্রতিরক্ষা শনাক্তকরণ অঞ্চলের কিছু অংশও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনকি চীনের মূল ভূখণ্ডের কিছু অংশও রয়েছে। যদিও তাইওয়ানকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে বেইজিং।
এদিকে পেলোসি তাইওয়ান পৌঁছানোর দিন সীমান্তের কাছে চীনা সাঁজোয়া যান এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামের বহর দেখা যায়। টুইটারে ‘ইয়িন সুরা’ নামক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, চীনের ফুজিয়ানের ব্যস্ত রাস্তায় সারি সারি ট্যাংক। আরও একটি ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে, পেলোসি তাইওয়ান পৌঁছানোর দিন সন্ধ্যায় অঞ্চলটির সীমান্তের কাছে সেনা জমায়েত করতে শুরু করে বেইজিং।
এর আগে বেইজিং সতর্ক করেছিল, পেলোসির সফরের পরিণতি ‘খুব গুরুতর’ হবে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, পেলোসি যদি তাইওয়ান সফরে যান, তাহলে চীনের সামরিক বাহিনী অলস বসে থাকবে না। আমেরিকা যদি হস্তক্ষেপ বন্ধ না করে, তাহলে চীন ‘বৈধভাবে যেকোনো পাল্টা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত’ বলেও সতর্ক করা হয়।
চীনা হুমকির প্রতিক্রিয়ার পর তাইওয়ানের পূর্ব সীমান্তে চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে হোয়াইট হাউস। পেলোসির নিরপত্তার অজুহাতে দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপরাষ্ট্রে আমেরিকার যুদ্ধবিমানের বহরও ঢুকে পড়েছে।
চীনের হুমকি অগ্রাহ্য করে মঙ্গলবার তাইওয়ান পৌঁছেছেন পেলোসি। বেইজিং সতর্ক করেছিল যে পেলোসির সফরের পরিণতি ‘খুব গুরুতর’ হবে। চীনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চুনয়িংয়ের দাবি, পেলোসি কোনও ব্যক্তিগত কাজে তাইওয়ান যাননি এবং আমেরিকা যদি হস্তক্ষেপ করা বন্ধ না করে তা হলে চীন ‘বৈধ ভাবে যে কোনও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত’। পেলোসির সফর চীনা নীতির পরিপন্থী হবে বলেও শি জিনপিং সরকার দাবি করেছে।
চীনা হুমকির প্রতিক্রিয়ার পর তাইওয়ানের পূর্ব সীমান্তে চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে হোয়াইট হাউস। পেলোসির নিরপত্তার অজুহাতে দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপরাষ্ট্রে আমেরিকার যুদ্ধবিমানের বহরও ঢুকে পড়েছে।
স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে এশিয়া সফরে রয়েছেন। মালয়েশিয়া থেকে গতকাল রাতে তারা তাইপে পৌঁছান। যদিও পেলোসির সফরের খবর জানার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়ে আসছিল চীন। এ নিয়ে ওয়াশিংটন-বেইজিং ব্যাপক উত্তেজনাও চলছে।
২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ান সফর করা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মার্কিন রাজনীতিবিদ পেলোসি। তবে তার সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সমর্থন দেননি। এদিকে পেলোসির তাইওয়ান সফরে ক্ষুব্ধ চীন। এই সফরকে বড় ধরনের উসকানি মনে করছে বেইজিং। এর পরিণতি ভালো হবে না বলে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে।
রাশিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছে, পেলোসির সফর উসকানিমূলক এবং তা এ অঞ্চলের জন্য অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে।
এদিকে তাইওয়ানে পৌঁছানোর পর টুইট করে পেলোসি বলেন, তার প্রতিনিধিদলের সফর ‘তাইওয়ানের গতিশীল গণতন্ত্রের’ প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবিচল প্রতিশ্রুতিকে সম্মানিত করেছে।
পেলোসির তাইওয়ান সফরের তীব্র নিন্দা এবং একে এক চীন নীতির গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে চীন। বেইজিং বলেছে, এই সফর চীন-মার্কিন সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রকে আগুন নিয়ে না খেলার ব্যাপারে সতর্ক করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।
এখনকার আগুন নিয়ে খেলার আলাপ তাইওয়ান নিয়ে হলেও দক্ষিণ চীন সাগরে আগুন লেগে আছে বেশ কয়েক বছর ধরেই।
দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে ছয়টি দেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ আছে। ১৯৪০ সালের পর চীন ‘নাইন ড্যাশ লাইন’-এর মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সমুদ্রের যে মালিকানা দাবি করেছে, তাতে কার্যত পুরো (৯০ শতাংশ) সমুদ্র তাদের করায়ত্ত হয়। চীনের এ দাবি মানা হলে চীনের সমুদ্রসীমা তার মূল ভূমি থেকে দুই হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত যায়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে চীনের সমুদ্রসীমা ঢুকে পড়ে অন্য দেশের দাবিকৃত সমুদ্রসীমার মধ্যেও। শুধু সেটাই নয়, এ সাগর পুরো নিজের কবজায় রাখতে চীন অনেকগুলো পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেগুলো এ সাগরে ‘আগুন লাগিয়ে’ দিয়েছে।
দক্ষিণ চীন সাগরের স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জ থেকে চীনের দূরত্ব এর আশপাশের অন্য সব দেশের (ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম) চাইতে অনেক বেশি। কিন্তু ২০১৩ সালে চীন এ দ্বীপপুঞ্জে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই ভৌগোলিকভাবে এই দ্বীপপুঞ্জের অনেক কাছাকাছি থাকা ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম তার প্রতিবাদ করেছে। চীনের এ আচরণের গৌণ কারণ হচ্ছে এই দ্বীপপুঞ্জ এলাকা তেল-গ্যাস ও মৎস্যসম্পদে ভীষণ সমৃদ্ধ। চীনের মুখ্য উদ্দেশ্য, নিজের মূল ভূমি থেকে এতটা দূরে এসে কিছু ভূখণ্ডকে নিজের বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে চীনের পক্ষে দক্ষিণ চীন সাগরে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
দক্ষিণ চীন সাগরে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে আগুন জ্বালিয়েছে চীন। আগুন নিয়ে দীর্ঘকাল খেলেছেও তারাই। বিশেষ করে সি চিন পিং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে চীন ভীষণ আগ্রাসীভাবে তার শক্তি প্রদর্শন করতে শুরু করেছে। ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে বরং আমরা দেখতে পেয়েছি, আমেরিকাই চীনের আগুন নিয়ে খেলার জবাবে শান্ত থেকেছে। তার মানে এই না, আমেরিকা নিজেও এ খেলায় আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে না।
আমরা পছন্দ করি বা না করি, বৃহৎ শক্তিগুলো আগুন নিয়ে খেলে, খেলতে পছন্দ করে কিংবা খেলতে বাধ্য হয়। বিশেষ করে কোনো দেশ যদি নিজের মতো করে বিশ্বব্যবস্থা গড়তে কিংবা টিকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে তাদের আগুন নিয়ে খেলাটা অনিবার্য। এটা করা কতটা ভালো কিংবা কতটা খারাপ, সেটা ভিন্ন আলোচনা, তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এটাই ঘটেছে, ঘটবে ভবিষ্যতেও। এখন দেখা যাক ইউক্রেনের পাশাপাশি তাইওয়ানকে ঘিরে দুই ব্লকের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনা কতদূর আগায়!
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ