এ সময়ের ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’টা শুরু হয়েছে তাইওয়ানকে মাঝখানে রেখে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই ‘যুদ্ধ’ বিবৃতি উত্তেজনাতেই আর সীমিত থাকবে কি? নাকি অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের মহা সমরে রূপান্তরিত হচ্ছে সেটা?
সামরিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান—প্রতিপক্ষের উসকানি এত তীব্র যে তাইওয়ানের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে যেতে পারে। চীনও সচেতনভাবে সেটা চাইছে। আবার কারও কারও মতে যুদ্ধ নয়, রাজনৈতিক স্বার্থ, অস্ত্র ব্যবসা ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তাইওয়ানকে ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে।
ওয়াশিংটন একদিকে তাইওয়ানের জন্য ভরসা, অন্যদিকে প্রবল দুশ্চিন্তাও বটে। ওয়াশিংটন ‘এক চীন’ নীতির অনুসারী। তাইওয়ানকে আলাদা পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রসত্তা গণ্য করে না তারা। তবে তারা তাইপের কাছে নিয়মিত অস্ত্র বিক্রি করে যাচ্ছে। দ্বীপটির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে তার বিপুল দ্বিপক্ষীয় কারবার আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা তাইওয়ানের আত্মরক্ষায় পাশে থাকার মৌখিক অঙ্গীকারও করেন প্রায়ই। যুক্তরাষ্ট্র যে তাইওয়ানের আত্মরক্ষায় সাহায্য করবে, এ বিষয়ে ১৯৭৯ সালে ‘তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট’ নামে আইনও করেছে কংগ্রেস। প্রশিক্ষক হিসেবে এক–দুই ডজন মার্কিন সৈন্যও তাইওয়ানে আছে বলে খবর বেরিয়েছে।
বিশ্বের ২০তম অর্থনীতির দেশ তাইওয়ান। সমৃদ্ধ দেশ। সম্পদের বড় অংশ এখন ঢালছে সামরিক খাতে। এই অঞ্চলে উত্তেজনা যত বাড়বে, একইভাবে সামরিক ব্যয় বাড়াতে বাধ্য হবে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এসব বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক। ‘উত্তেজনা’ আছে বলেই তারা এ অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতিও বাড়াতে পারছে। বলা যায়, চীন-তাইওয়ান উত্তেজনায় বহুভাবে সরাসরি লাভবান ওয়াশিংটন।
এই যেমন সম্প্রতি তাইওয়ানের কাছে ১১০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে শুক্রবার ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা এসেছে। তাইওয়ান নিয়ে চীনের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে এই ঘোষণা দিল যুক্তরাষ্ট্র। খবর এএফপির।
সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করেন। তাঁর ওই সফর নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা শুরু হয়। তাইওয়ানের চারপাশে বড় ধরনের সামরিক মহড়া চালায় বেইজিং। এমন পরিস্থিতিতেই তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দিল যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানে নতুন করে যে অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে এর মধ্যে আছে ৬৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ‘রাডার ওয়ার্নিং সিস্টেম’। এর মাধ্যমে ধেঁয়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করা যাবে। এ ছাড়া আছে ৩৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ৬০টি হারপুন ক্ষেপণাস্ত্র, যা যেকোনো জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম।
তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রির এ অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তার জন্য এসব অস্ত্র খুব জরুরি।
তিনি বলেন, ‘তাইওয়ানের ওপর সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ দেওয়া থেকে সরে আসার জন্য আমরা বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা চাই এর পরিবর্তে তাইওয়ানের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনায় করুক চীন।’
তবে তাইওয়ানের কাছে এই অস্ত্র বিক্রিতে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে। তবে তাইওয়ান প্রশ্নে কংগ্রেসের উভয় দল সব সময় সমর্থন দিয়ে আসছে। তাই কংগ্রেস তাইওয়ানের কাছে নতুন করে এসব অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন শিগগিরই দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীন-রাশিয়া-ভারত
চীন ও ভারতসহ কয়েকটি দেশের অংশগ্রহণে রাশিয়ায় বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে সামরিক মহড়া শুরু হয়েছে। ভারত-চীন ছাড়াও বেলারুশ, মঙ্গোলিয়া, তাজিকিস্তান, সিরিয়া, লাওস ও নিকারাগুয়ার মতো দেশগুলো এতে অংশ নিয়েছে। শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
‘ভোস্তক ২০২২’ শীর্ষক এই মহড়ার আয়োজন করেছে রাশিয়া। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যৌথ এই মহড়ায় অর্ধলক্ষাধিক সেনাসদস্য অংশ নেবে। এ ছাড়া দেড় শতাধিক যুদ্ধবিমান, ৬০টি যুদ্ধজাহাজ মহড়ায় অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।
চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে রাশিয়ার উদ্যোগে আয়োজিত এই মহড়ায় অংশ নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। বেইজিং বলছে, যৌথ মহড়ায় অংশ নিতে তারা রাশিয়ায় ১০ হাজারের বেশি সেনা পাঠাচ্ছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এই মহড়ার উদ্দেশ্য হল অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সেনাবাহিনীর সাথে ব্যবহারিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতাকে গভীর করা এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা করার ক্ষমতা জোরদার করা। তবে বেইজিং বলছে, এই যৌথ মহড়ায় চীনের অংশগ্রহণের সঙ্গে বর্তমান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই।
এদিকে পূর্ব লাদাখে চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যেই ভারতীয় সামরিক বাহিনীও এতে যোগ দিচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে দিল্লি।
বৃহস্পতিবারের বিবৃতিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতীয় সেনার একটি বহর মহড়াস্থলে পৌঁছেছে এবং আগামী ৭ দিন ধরে তারা মাঠ পর্যায়ে যৌথ প্রশিক্ষণের অনুশীলন, যুদ্ধ আলোচনা ও গোলা ছোড়ার অনুশীলনসহ নানান পর্বে অংশ নেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ
এদিকে আসন্ন এই যৌথ সামরিক মহড়ার বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে এই মহড়া আয়োজন এবং ভারত-চীনের অংশগ্রহণ এর গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিষয়টিকে বাইডেন প্রশাসন গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
উল্লেখ্য, চীন এবং ভারতের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে চলোমান যুদ্ধে রাশিয়াকে কূটনৈতিক সহযোগীতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়াও রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং কিয়েভের কাছে অস্ত্র বিক্রির বিরোধিতা করেছে দুই দেশ।
এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক মহড়ায় এই দুই দেশের অংশগ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩৫
আপনার মতামত জানানঃ