হিরো আলম প্রশ্নে তসলিমা নাসরিনের অবস্থান গোটা দেশকেই এক কথায় রিপ্রেজেন্ট করছে। প্রথমে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ রবীন্দ্র প্রেমে কলকাতা থেকে এগিয়ে। পুলিশ দিয়ে ডলা দিয়ে ভালো কাজই করেছে। বেশ একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন। এরপর একশ আশি ডিগ্রী টার্ন নিয়ে জানিয়েছেন, ভুল সুরে গান গাওয়ার অধিকার সবার আছে, পুলিশ ভুল করেছে সহ আরও অনেক কিছু।
মূল ঘটনায় আসি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত ব্যক্তিত্ব আশরাফুল আলম সাঈদ ওরফে হিরো আলমকে শুধু রবীন্দ্র বা নজরুল সঙ্গীত গাইতে নিষেধ নয় তার ‘হিরো’ নাম পাল্টানোর নির্দেশও দিয়েছে পুলিশ।
বুধবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে নেয়া হয়। এরপর নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে ভিডিও পোস্ট করেন তিনি।
তবে বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন তাকে গান গাইতে নিষেধ করে তার ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতায়’ হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। পুলিশ তার ‘হিরো’ নাম পাল্টানোর নির্দেশ দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তবে গান বা অভিনয় বন্ধ করবেন না বলে জানান তিনি।
বিবিসি বাংলাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, হিরো আলমকে ‘বিকৃত’ভাবে গান প্রচার করতে নিষেধ করেছে তারা। তিনি বলেন, গান গাওয়ার অধিকার সবার আছে তবে কোনো গান বিকৃতভাবে গাওয়ার অধিকার কারো নেই।
তবে একজন মানুষ যদি ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো উন্মুক্ত পরিসরে নিজের গাওয়া গান আপলোড করেন, তাহলে তাকে ‘সাতসুর জানা আছে?’ জিজ্ঞাসা করা বা ‘গাধার পিঠে চাপিয়ে গাঁ থেকে বের করে দেওয়া’ কোন আইনে যথোচিত? আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রভারতীও রবীন্দ্র-সংস্কৃতি নিয়ে এ ধরনের নীতিপুলিশি করেছে বলে শোনা যায়নি। তাই হিরো আলমকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া ও রবীন্দ্রসংগীত না গাওয়ার মুচলেকা নেওয়া কতটা আইনসিদ্ধ হয়েছে সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
হিরো আলম অভিযোগ করে বলেন, ”তারা আমাকে বলেছে, তোর চেহারা কি আয়নাতে কোনোসময় দেখছিস, তুই নিজেকে হিরো দাবি করিস। তুই আজকের পর থেকে তোর হিরো নামটা বাদ রাখবি। এ বিষয়টা নিয়ে তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। তোর জন্য কথা হচ্ছে, বাইরে থেকে ভাবমূর্তি নষ্ট হইতেছে, তুই হিরো দাবি করিস নিজেকে, তুই জানিস হিরো শব্দের অর্থ তুই জানিস। হিরো মানে সুন্দর হইতে হয়, ফিটফাট হইতে হয় কথাবার্ত সব কিছু থাকা লাগে। সিনামা দেখিস নাই হিরো কাকে বলে?”
বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হিরো আলমের বিরুদ্ধে ডিবি সাইবার ক্রাইম বিভাগের কাছে অনেক অভিযোগ এসেছে। এই প্রেক্ষিতে আজ তাকে ডাকা হয়। পুলিশের যে ড্রেস, যে প্যাটার্ন, ডিআইজি, এসপির যে ড্রেস, তা না পরে কনস্টেবলের ড্রেস পরে তিনি ডিআইজি, এসপির অভিনয় করেন। ডিএমপি শিল্পী সমিতিকে বলেছে, পুলিশের পোশাক পরে অভিনয় করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু হিরো আলম শিল্পী সমিতির সদস্যও না। অথচ তিনি অনুমতি ছাড়া পুলিশের পোশাক পরছেন। কনস্টেবলের ড্রেস পরে এসপি-ডিআইজির অভিনয় করছেন। এটা তিনি জানেনও না।
তিনি আরও বলেন, হিরো আলম যেভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি করেছেন তাতে সেগুলো পুরোটাই চেঞ্জ (বিকৃত) করে দিয়েছেন। আমরা জিজ্ঞেস করেছি, আপনি এসব কেন করেন? তখন হিরো আলম আমাদের বলেছেন, আমি আর জীবনে এসব করব না। আমি আর পুলিশের পোশাক পরব না। রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীতও বিকৃত করে গাইব না।
এবার এখানে প্রশ্ন, কে নামের আগে কী লিখবে তা নিয়ে কথা বলার ডিবি কে? ডিবির নির্দেশ এবং আচরণ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে হিরো আলম বলেছেন, “আমার সম্মানবোধ বলতে কিছু আছে। কিন্তু তারা সেই সম্মানবোধ দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেনি। নাগরিক হিসেবে আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করার কথা ছিল তা করেনি। বাংলাদেশের কোনো আইনে নেই যে আমার নাম পরিবর্তন করতে হবে, এমন আইন নেই যে আমি নির্দিষ্ট কোনো গান গাইতে পারবো না, অভিনয় করতে পারবো না।”
হিরো আলমের দাবি সত্যি হলে তার সঙ্গে খুবই অন্যায় হয়েছে৷ এমন আচরণ দিয়ে পুলিশ বা ডিবি পুলিশ কোনোদিন সত্যিকার অর্থে ‘জনগণের বন্ধু’ হতে পারবে না৷ জনগণের বন্ধু হতে হলে মানুষের মন বুঝতে হবে, মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে জানতে হবে৷ ভালো শিল্পীর যেমন কণ্ঠে সুর থাকতে হয়, ‘শুদ্ধ সুর ও কথায়’ গাইতে হয়, ‘ভালো’ পুলিশেরও তেমনি সবার আগে থাকতে হয় মনুষত্ব৷ মনুষত্ব সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় মানবিক আচরণে৷
গান গাইতে বারণ করা, নাম বদলাতে বলা, চেহারা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা, দুর্ব্যবহার করা-এসব আইনসঙ্গত নয়, কাঙ্খিতও নয়৷ এমন আচরণের জন্য ডিবির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচিত আবার হিরো আলমের কাছে যাওয়া, তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করা৷ হিরো আলমেরও উচিত যে কোনো কাজ ভালোভাবে করার চেষ্টা করা৷ লেখাপড়া শিখতে চাইলে যেমন শেখা যায়, সংগীত আর অভিনয়ও তেমনি শেখা যায়, শিখে উন্নতিও করা যায়৷ শিখে উন্নতি করা না গেলে বিশ্ব কোনোদিনই ‘আধুনিক’ হতো না, মানুষ আদিম যুগেই থেকে যেতো৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ