উন্নয়ন, আশীর্বাদ না অভিশাপ! এই দ্বিধা কাটাতে কিছুটা অতীতে যাওয়া যাক। যাওয়া যাক ব্রিটিশ আমলে। আমাদের নদীগুলো উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। সেসবকে হাজারো জায়গায় কাটাকুটি করে গেছে পূর্ব-পশ্চিমগামী রেললাইন। ফলে, বন্যার পানি বয়ে যাওয়ার প্লাবনভূমিতে উঁচু রেলবাঁধ পড়েছে। এভাবে নদীশাসনের নামে নদীর গতি নষ্ট করে সৌভাগ্যের জননীকে পরিণত করা হয় দুর্যোগের ডাকিনীতে।
ব্রিটিশ নদীপ্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ১৯২৮ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় অভিযোগ করেন, ‘ইংরেজ আমলের গোড়াতেই সনাতন খালব্যবস্থাগুলোকে কাজে লাগানো ও সংস্কার তো করাই হয়নি, বরং রেলপথের জন্য তৈরি বাঁধের মাধ্যমে এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।’
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জি থমসনও হিন্দু ও মুসলিম যুগের নদীব্যবস্থাপনা ধ্বংসকেই বাংলার কৃষি ও জলদেহকে বিপর্যস্ত করার দায় দিয়েছেন। তাতে মাটি অনুর্বর হয়েছে, মাছের আধার ধ্বংস হয়েছে, ম্যালেরিয়া মহামারি আকার পেয়েছিল এবং নদী স্ফীতিজনিত চাপে নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশ ভরে গেছে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় পৌর্তিক কাজ দিয়ে।
ভারতীয় নদীবিশেষজ্ঞ প্রশান্ত মহলানবীশ সেই ১৯২৭ সালেই বলেছিলেন, বাঁধের ফলাফল হিসেবে তলানি জমে নদীতল ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসবে। উন্নয়নবাদীরা শোনেননি। সে সময়ের এক বড় বন্যা ছিল ১৯৪৩ সালের দামোদরের বন্যা। ওই সময় ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’ লিখেছিল, ‘বন্যার জন্য দায়ী নদ-নদী নয়, অতিবৃষ্টি নয়, দায়ী ব্রিটিশের তৈরি রেলপথ’। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে এই দশকে। উন্নয়ন ডেকে আনছে ধ্বংস।
বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষের দুর্ভোগের অবসান এখনো ঘটেনি। কুড়িগ্রাম থেকে সুনামগঞ্জ—বাংলাদেশের উত্তরের পশ্চিম থেকে পূর্বভাগের লাখ লাখ মানুষ বন্যার্ত। ঘরবাড়ি ভেসে গেছে, ফসলি জমি বিনষ্ট, গবাদিপশু বিপন্ন। ৬ জুলাই ২০২২-এর ইউএনবি পরিবেশিত খবর: বাংলাদেশে বন্যায় মানুষ মারা গেছেন ১১০ জন।
এই বন্যার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হচ্ছে রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টিকে। ভুটান থেকে শুরু করে কোচবিহার, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার পাহাড়ি এলাকায় অতি অল্প সময়ে অনেক বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টির পানি নেমে এসেছে ভাটির সমতলে, বাংলাদেশে।
ভারতেও পাহাড় কেটে বন ধ্বংস করে নানা রকমের বসতি বা স্থাপনা বসেছে, কৃষিকাজ হচ্ছে। ফলে সেখানেও যেমন পাহাড়ধস ঘটছে বেশি, তেমনি সেখানকার জমিনও পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এসব পাহাড় ধসা মাটি পাহাড়ি ঢলে নেমে আসছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের নদী ও প্লাবনভূমি পলি পড়ে উঁচু হয়ে গেছে। সেসবের পানি ধারণ করার ক্ষমতা ও পরিবহনক্ষমতা কমে গেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ। পানি নেমে যাওয়ার স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এবারের বন্যা সম্পর্কে এলাকাবাসী বলছেন, এত বন্যা তারা জীবনেও দেখেননি।
মূলত যেকোনো স্থাপনাই পরিবেশের স্বাভাবিকতা কিছু না কিছু ব্যাহত করবেই। আমরা যদি একটা টিনের ঘরও বানাই, তারও একটা প্রতিক্রিয়া আছে। সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে তা বায়ুস্তরকে উষ্ণতর করে তুলবে, বৃষ্টির পানি মাটির ভেতরে যাওয়ার পরিসর কমিয়ে ফেলবে। কাজেই মানুষের যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প প্রকৃতির স্বাভাবিক চক্রের ওপরে প্রভাব ফেলে।
সারা পৃথিবীতে চলছে বাঁধবিরোধী প্রচারণা। চীনে, ভারতে, বাংলাদেশে বাঁধ নির্মাণ চলছেই। তবে ভারতের পরিবেশ-আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের মুখে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়েছে। আপাতদৃষ্টে টিপাইমুখ বাঁধ কিন্তু উপকারী বলেই মনে হবে। কারণ, তা বর্ষাকালে পানি ধরে রাখবে, শীতকালে ছাড়তে থাকবে।
কিন্তু পরিবেশবিদেরা বলেন, তা হাজার হাজার বছরের পরিবেশচক্রকে ভেঙে ফেলবে। বর্ষায় পানি আসবে, শীতকালে শুকনা থাকবে—এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এ চক্র ভেঙে গেলে কী ঘটবে, তা আমরা জানি না। আর ভূমিকম্পপ্রবণ টিপাইমুখ এলাকায় ভূমিকম্পের কারণে বাঁধ ভেঙে গেলে প্রলয় ঘটে যাবে।
এই যেমন বিবিসি বাংলায় ১৮ জুন ২০২২ বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, ‘হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে।’
সরকারি উন্নয়নবিদদের চোখে হাওর পর্যটন এলাকা। তাই পর্যটনের সুবিধার জন্য হাওরের বুক চিরে খুব সুন্দর সড়ক তৈরি করা হয়েছে। বাইকার ও গাড়িঅলারা সাঁই সাঁই করে সেসব রাস্তায় ঘুরেছেন আর সুন্দর সুন্দর ছবি তুলেছেন। এখন প্রকৃতি খুব সুন্দর করে তার প্রতিশোধ নিয়েছে। ভুল সড়ক, ভুল বাঁধ আর অবকাঠামো নির্মাণের প্রতিক্রিয়ায় পানি নামতে পারছে না বলে সহনশীল বন্যা দুঃসহ হয়ে উঠেছে।
কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা থেকে শুরু করে সিলেট বেসিন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ প্লাবনভূমি। এই ভূমি দিয়ে পূর্ব ভারত দিয়ে আসা নদী ও বৃষ্টির ঢল নেমে আসে। বাংলাদেশের অন্যতম এক প্রাণভোমরা এই হাওর। পরিবেশবিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদ ড. খালেকুজ্জামানের ভাষায়, ‘হাওর ১৪০ প্রজাতির মাছের প্রজননক্ষেত্র; ২০৬ প্রজাতির পাখি, ২০০ প্রজাতির গাছ, ৩৪ প্রজাতির রেপটাইল এবং ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাস এই হাওরে। হাওরের জীববৈচিত্র্যের তুলনা একমাত্র সুন্দরবন।
তবে এই ভূমিতে যত হাজার কোটি টাকার উন্নয়নই ঢালা হোক, তা হয় নিজে ভেসে যাবে, নাহয় লাখো মানুষকে ভাসাবে। সেটাই হয়েছে। কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলায় ৮৭৪ দশমিক ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়কের কারণে ঢলের পানি হাওর থেকে নদীতে নামতে বাধা পাচ্ছে। জলাবদ্ধতায় সড়কের দুপাশে ধানখেত ডুবে থাকছে। এ পানিতে ধান পচে যায়।
পরিবেশবিজ্ঞানী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা চালানো হয়নি। তিনি বলেন, ‘হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো, জলের অবাধ প্রবাহ। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয়, তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটারের এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানি প্রবাহের সুযোগ রাখা হয়।’
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে উজানে ভারতের তৈরি অজস্র বাঁধ-জলাধার, অজস্র ব্যারাজ, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও জলকাঠামো। এসবের কারণে নদী আর পলি বইতে পারছে না। পলি বইতে না পারলে পানিও বওয়া কঠিন হয় নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায়। ফলে নদী পানি উগরে দিচ্ছে, অস্বাভাবিক বন্যা হচ্ছে। অবস্থা হয়েছে এমন, ভারতের উজানে বন্যা ১০ দিন চললে বাংলাদেশে চলে মাসের বেশি দিন। পানি নামার পথে উন্নয়নের অনেক বাধা যে!
এখন সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, বন্যার পানি নামাতে প্রয়োজনে সড়ক কেটে দিন। কাটবেনই যদি তবে বানিয়েছিলেন কেন? বানালেনই যদি তবে ঘন ঘন কালভার্ট করেননি কেন? ২০১৭ সালে হাওরের বাঁধ ভেঙে পড়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ইঁদুরকে দায়ী করেছিল।
অথচ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল পাউবোর অনিয়ম আর ঠিকাদারদের দুর্নীতির কথা। স্থানীয় যুবলীগ নেতা এক ঠিকাদারকে আটকও করা হয়েছিল বিমানবন্দর থেকে। এবার সব নিশ্চুপ। শুধু আসামের বৃষ্টিকে দুষলে হবে না, গত এক যুগে হাওর ও সিলেটের জলপ্রবাহের ওপর কী কী অনাচার করা হয়েছ, তার তালিকা বের করতে হবে। দায়ীদের এবং তাদের ভুল উন্নয়ন দর্শনকে একসঙ্গে পরিত্যাগ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ