দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা আপাতত নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে না সরকার। তবে মাদ্রাসার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে নজরদারি অব্যাহত থাকবে।
এর আগে সিদ্ধান্ত ছিল কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম উন্নয়নে শিক্ষা আইনে সুনির্দিষ্ট প্রস্তবনা থাকবে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মমুখী শিক্ষাও সংযুক্ত করা হবে। পরিমার্জন আনা হবে চূড়ান্ত খসড়ায়। কিন্তু সম্প্রতি চূড়ান্ত হওয়া শিক্ষা আইনের খসড়ায় নিয়ম-কানুন আগের মতোই রাখা হয়েছে। বাড়তি কোনও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। নতুন করে কিছু সংযুক্ত করা হয়নি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে উন্নয়নের কথা ভাবা হলেও মাদ্রাসা পরিচালনাকারীরা তা চান না। এ কারণে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে একটি কাঠামোয় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেও তা আর হয়নি। এখন ‘সরকার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’ অংশটুকু রেখে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত সংক্রান্ত বৈঠকে কওমি মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ‘সরকারের নিয়ন্ত্রণে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রম উন্নয়ন করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কারণ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।’ ওই সিদ্ধান্তের আলোকে কওমি শিক্ষার বিষয়টি আইনের খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যাতে কর্মক্ষেত্রের জন্য যোগ্য এবং দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে, সেজন্য এই শিক্ষা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করার বিষয় সরকার বিবেচনা করছে।
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় কোন শৃঙ্খলা নেই; এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময়ই আলোচনায় এসেছে। এনিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও অনেক বিতর্ক হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম খতিয়ে দেখে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে উন্নয়নের কথা ভাবা হলেও মাদ্রাসা পরিচালনাকারীরা তা চান না। এ কারণে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কওমি মাদ্রাসাগুলোকে একটি কাঠামোয় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেও তা আর হয়নি। এখন ‘সরকার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’ অংশটুকু রেখে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের বোর্ড এবং সরকারের কোন পর্যায়ের প্রশাসনের কোন অনুমতির প্রয়োজন হয় না। এছাড়া সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম বা নীতিমালাও নেই।
সরকারের একটি কমিটি খতিয়ে দেখেছে যে, শহর থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত অনেক কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে কোনভাবে একটি ঘর ভাড়া করে। যেখানে শিক্ষার পরিবেশ নেই।
এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স এর মর্যাদা দিয়েছে। এর ভিত্তিতে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন চাকরিতে প্রবেশের বা কর্মক্ষেত্র খুঁজে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সেকারণে এই শিক্ষাকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে নিবন্ধনের ব্যবস্থাসহ একটি সমন্বিত নীতিমালার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল হেফাজতকাণ্ড, মোদি-বিরোধী আন্দোলন ও গত বছর মামনুলকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে সহিংসতা চালানো হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে কওমি শিক্ষাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় রাজনীতিতে যুক্ত করা ও সহিংসতায় ব্যবহারের অভিযোগের পর গত বছর ২১ জুন দেশের সব মাদ্রাসা নিবন্ধনের আওতায় আনার একটি কমিটি গঠন করে সরকার। এরপর কওমি মাদ্রসাসহ সব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেজ তৈরির কাজ শুরু হয়।
কওমি, নুরানি, দিনিয়া, ফোরকানিয়া ও ইবতেদায়িসহ সকল ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হয়।
বেসরকারি মাদ্রাসা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ১৪ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসায় ১৪ লাখের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।
ডাটাবেজ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে কওমি মাদ্রাসা আছে ১৯ হাজার ১৯৯টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ।
২০১৫ সালে এ মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৯০২টি। গত পাঁচ বছরে মাদ্রাসার সংখ্যার বাড়ার পাশপাশি শিক্ষার্থীও বেড়েছে বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
দেশের ১৬ হাজারের বেশি মাদ্রাসার পৌনে দুই লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর শতভাগ বেতনভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হলেও এগুলো পরিচালনায় কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই সরকারের। সুপার, অধ্যক্ষ কিংবা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের স্বেচ্ছাচারিতায় পরিচালিত হচ্ছে বেশিরভাগ মাদ্রাসা। নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ লুটপাটসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। শিক্ষার মানও নিম্নগামী হচ্ছে দিন দিন।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় শূন্যপাসের প্রতিষ্ঠানের তালিকায় শীর্ষে থাকছে মাদ্রাসা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হলেও মাদ্রাসাগুলোতে শিশু শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রভাব পড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। নিজ প্রতিষ্ঠানেই যৌন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে অনেক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। তবে সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় এসব কর্মকাণ্ডের কোনো তথ্যই পৌঁছাচ্ছে না শিক্ষা বিভাগে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরেই অভিযুক্ত শিক্ষকদের এমপিও স্থগিত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এ কারণে স্থানীয় প্রভাববলয় তৈরি করে নিজেদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণেই নিজ মাদ্রাসায় নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। ভয় আর লজ্জায় নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ না করায় চাপা পড়ে যায় সেসব ঘটনা। যেসব ঘটনা সামনে আসে প্রভাবশালীদের কারণে তাও একসময় চাপা পড়ে। এতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তারা। বিশেষত পরিচালকদের হাতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা শিউরে ওঠার মতো।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিক্ষকদের কাছে যদি শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে তার চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর নেই। তবে প্রতিটি বিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ সেল গঠন করার কথা থাকলেও মাদ্রাসাগুলোতে তা মানা হচ্ছে না।
শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিবন্ধন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ ছাড়া পৃথিবীর কোনও দেশে কোনও ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় না। ভারতেও দেওবন্দ নিবন্ধন নিতে হয়। আইনে সেভাবে রাখা না হলেও অন্তত নিবন্ধন থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া তাদের তথ্য পাওয়া যাবে কীভাবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সন্তান কোথায় কী লেখাপড়া করছে তা জানা দরকার। কওমিসহ দেশের সব শিক্ষা ধারাকে একটি ছাতার নিচে এনে যার যার স্বাতন্ত্র বজায় রেখে চালাতে হবে। এই শিক্ষা ধারাকে একটি রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলছে, আয়ের উৎস কী, পাঠ্যক্রম কী, কী শেখাচ্ছেন তা তো জানতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০২
আপনার মতামত জানানঃ