মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশ থেকে লাখো মানুষের স্রোত ধাঁই করেছে ইউরোপের দিকে। প্রত্যাশা একটাই—একটুখানি আশ্রয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে এই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে।
প্রাণ বাঁচাতে, জীবিকা খুঁজে নিতে ছুটছে এসব মানুষ। ছুটন্ত এসব অভিবাসন-প্রত্যাশীর দেশগুলোতে চলছে সংঘাত, অস্থিরতা, নিপীড়ন, বঞ্চনা। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ তাদের জীবন। টিকে থাকার মৌলিক চাহিদার জন্য ব্যাকুল তারা। চাই খাদ্য, নিরাপত্তা আর আশ্রয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা রেকর্ড ছুঁয়েছে! ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটে থাকা ২৭ রাষ্ট্রে আশ্রয়প্রার্থীর হার ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কমপক্ষে ৬ লাখ ৪৮ হাজার আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপের দেশগুলোতে আবেদন করেছেন। শীর্ষ ছয় আবেদনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম! মঙ্গলবার(২৮জুন) প্রকাশিত আশ্রয়প্রার্থী বিষয়ক ইইউ’র বার্ষিক রিপোর্টে বিস্তারিত ওঠে এসেছে। রিপোর্টে ২০২১ সালের পাশাপাশি ২০২২ সালের প্রথম দিকের পরিস্থিতি, বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনে শরণার্থী পরিস্থিতি কতোটা জটিল রূপ নিয়েছে, তা তুলে ধরা হয়েছে।
ব্রাসেলসের স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার সকালে ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশ্রয়প্রার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইইউএএ) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ইইউএএ ২০২১ সালের পরিস্থিতির পাশাপাশি ২০২২ সালের প্রথম দিকের পরিস্থিতি, বিশেষ করে ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। ইউরোপে গত ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম স্থলযুদ্ধের প্রভাব বিশ্বের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিতে পড়া মানুষের সুরক্ষার বিষয়টি জোরালো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আবেদনকারীর হার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের দিকে সংখ্যাটি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মানুষের আবেদনের হার বেড়ে যাওয়ায় এই সংখ্যা হঠাৎ করে বৃদ্ধি পায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আশ্রয়প্রার্থীর আবদনের তালিকার শীর্ষ রয়েছে সিরিয়া। সে দেশ থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার মানুষ আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। সিরিয়া ছাড়া শীর্ষ ছয় দেশের তালিকায় রয়েছে—আফগানিস্তান (১ লাখ ২ হাজার), ইরাক (৩০ হাজার), পাকিস্তান ও তুরস্ক (২৫ হাজার করে) এবং বাংলাদেশ (২০ হাজার)।
ইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ৬ লাখ ৪৮ হাজার আশ্রয়প্রার্থীর আবেদনের মধ্যে ৫ লাখ ৩৫ হাজার আবেদন প্রাথমিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এঁদের মধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজারকে শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সম্পূরক সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে ৬৪ হাজার আবেদনকারীকে। আশ্রয় চেয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে ফ্রান্সে (১ লাখ ৯১ হাজার), স্পেনে (৬৫ হাজার) ও ইতালিতে (৫৩ হাজার)।
আবেদনকারীদের ৭০ শতাংশই পুরুষ। ৬ লাখ ৪৮ হাজার আবেদনকারীর অর্ধেকের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছর। মোট আবেদনকারীদের ২৯ শতাংশের বয়স ১৯ বছরের কম। সঙ্গীহীন কিশোরের মধ্যে দুই–তৃতীয়াংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর।
আবেদনকারীদের ৭০ শতাংশই পুরুষ। ৬ লাখ ৪৮ হাজার আবেদনকারীর অর্ধেকের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছর। মোট আবেদনকারীদের ২৯ শতাংশের বয়স ১৯ বছরের কম। সঙ্গীহীন কিশোরের মধ্যে দুই–তৃতীয়াংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল—এই পাঁচ বছরে ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন প্রতিবছর ১১ হাজারের বেশি। করোনা সংক্রমণের শুরুর বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল ১১ হাজার ৫৭০ জন। এ ছাড়া ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চার বছরে আবেদনের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৫ হাজার, ১৮ হাজার ৮৬৫, ১৩ হাজার ৭৪০, ১৫ হাজার ৮৪৫ এবং ১১ হাজার ৫৭০ জন। আর ২০২১ সালে ২০ হাজার ১১০ আবেদন পড়েছে।
সঙ্গীহীন কিশোর–কিশোরীদের আবেদনকারী শীর্ষ তিন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে। গত বছর আফগানিস্তান, সিরিয়া ও বাংলাদেশ থেকে আবেদনকারীর সংখ্যা যথাক্রমে ১২ হাজার ৫৭৫, ৩ হাজার ৮৬০ ও ১ হাজার ৩৪০ জন।
ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয়ের আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এমন শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। সিরিয়া, পাকিস্তান, কলম্বিয়া, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের সংখ্যা যথাক্রমে ২৩ হাজার ৯৮৫, ২০ হাজার ৮৭৫, ২০ হাজার ৪৫০, ১৬ হাজার ৯১০ ও ১৫ হাজার ৯৩৫ জন।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশ্রয়প্রার্থীবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছেন। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশ্রয়প্রার্থীবিষয়ক নীতিমালা সংস্কারের প্রশংসা করে আশা প্রকাশ করে বলেন, চেক প্রজাতন্ত্র ইইউর সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। ১ জুলাই থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পাচ্ছে এই দেশ।
ইইউএএর নির্বাহী পরিচালক নিনা গ্রেগোরির ভাষ্যমতে, আন্তর্জাতিক কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ ২০২১ সালে ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। এর ফলে আবেদনকারীদের সংখ্যা মহামারির আগের পর্যায়ে ফিরে এসেছে।
তিনি বলেন, ২০১৫–২০১৬ সালে সিরিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট শরণার্থী সংকটের পর গত বছর প্রতি মাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ ইউরোপে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। মূলত তিনটি কারণে আবেদনপ্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—অভিবাসীদের ওপর বেলারুশ সরকারের নিপীড়ন, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় ফেরা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউরোপের অভিবাসী সংকটের মূলে রয়েছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক ও ইয়েমেনের মত সংকটাপন্ন দেশগুলো। তাই যতদিন এইসব দেশের গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমিত না হবে ততদিন অভিবাসী সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এছাড়া আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোও যথেষ্ট সংখ্যাক অভিবাসী তৈরির জন্য দায়ী।
অফ্রিকায় সম্পদের কমতি না থাকলেও রাজনৈতিক অস্থীতিশীলতা, দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন এ অঞ্চল থেকে উল্লেখজনক হারে শরণার্থী তৈরি করছে। তাই অভিবাসী সংকট মোকাবেলায় আফ্রিকার উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেই সাথে প্রয়োজন শরণার্থী দেশগুলোর প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের আন্তরিক মনোভাব।
সিরিয়া কিংবা ইয়েমেনের অভিবাসীরা গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য ধনী দেশগুলোকে বেছে না নিয়ে দূর দুরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে বেছে নিচ্ছে ইউরোপকে। এর কারণ পার্শ্ববর্তী ধনী দেশগুলো তাদের আশ্রয় দিচ্ছে না। আশ্রয় না দেয়ার কারণ হলো তারা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে সাক্ষর করেনি। ফলে তারা বাধ্য নয় শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যে কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা সৌদি আরবের মত দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে এই শরণার্থীর দুর্দশা হয়ত কিছুটা হলেও লাঘব হত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০১
আপনার মতামত জানানঃ