সাভারের আশুলিয়ায় এক ছাত্র তার শিক্ষককে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করে৷ আহত শিক্ষক দুদিন পর গতকাল সোমবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা মারা যান৷ কিংবা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নড়াইল সদর উপজেলার এক কলেজ ১৮ জুন শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরান মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় কিছু ব্যক্তি৷ এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে আমাদের চারপাশে।
গত কয়েকবছরে শিক্ষক নির্যাতনের যে ঘৃন্য চিত্র উঠে এসেছে এবং বর্বরতার সকল সীমানা যেভাবে অতিক্রম করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এ পেশার মর্যাদা নিতান্তই মুখেমুখে এবং এ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময়ও হয়েছে।
আমরা ২০১৩ সালে দেখেছি পাবনায় একজন ছাত্র তথাকথিত অভিযোগে শিক্ষককে দুই হাতে ইট দিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেটা কিন্তু মিডিয়াতে আসেনি। তারপর আমরা ক্রমাগত শ্যামল কান্তির ঘটনা দেখেছি, আমরা সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কান ধরে ‘দুঃখিত স্যার, দুঃখিত স্যার’ বলেছি। কিন্তু যে সংসদ সদস্য শিক্ষার্থীদের সামনে তাকে চড় মেরেছিলেন, তাকে কি জবাবদিহিতায় আনা হয়েছিল? হয়নি।
তারপর আমরা দেখেছি শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে মারধর করা হয়েছে, জেলে নেওয়া হয়েছে। সেই ঘটনার মধ্যেই দেখলাম আশালতা নামের আরেকজন শিক্ষিকার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হলো, ছাত্রীরা বোরখা পরেছে বলে তিনি তাদের পিটিয়েছেন। কিন্তু পরে ছাত্রীরাই বলেছেন, আমরা স্কুল ড্রেস পরিনি বলে তিনি বকাঝকা করেছেন। অথচ, সেটিকে সাম্প্রদায়িকরণ করা হয়েছে। কারণ, তার একটা বাংলা (হিন্দু) নাম আছে সেজন্য। এবার আমরা দেখলাম একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরানো হলো! ওই শিক্ষক যখন নিজের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ডাকলেন; তখন সেই পুলিশের সামনেই এই ঘটনা ঘটানো হলো।
এদিকে, নিহত ৩৭ বছর বয়সি শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার এঙ্গেলদানি গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে শিক্ষক। তিনি আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। উৎপল পরিবার নিয়ে ঢাকার মিরপুরে থাকতেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।
সূত্র মতে, শনিবার দুপুরের দিকে কলেজের মাঠে ওই শিক্ষকের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় দশম শ্রেণির এক ছাত্র । এতে তিনি গুরুতর আহত হন। ওই ছাত্রকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷ জানা যায়, ঘটনার দিন স্কুলে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলছিল। দুপুরে মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষক উৎপলকে হঠাৎ করে এসে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকে ওই ছাত্র। স্ট্যাম্পের আঘাতে শিক্ষকের মাথা ফেটে যায়৷ চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
শিক্ষক নির্যাতনে কারণ ব্যাখ্যা করলে, এখানেও ধর্মান্ধতা প্রকট হয়ে উঠবে। সংখ্যালঘু শিক্ষকরাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বেশি। মূলত বাংলাদেশকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র বানানো হচ্ছে। যেখানে কেবল এক ধর্মের মানুষ বাস করবে। এর আগে দুর্গা পূজার সময় আমরা দেখেছি পুরো বাংলাদেশ জুড়ে অসংখ্য পূজা মণ্ডপ ও মন্দিরে ভাংচুর-নাশকতা। এবং আমরা দেখলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী নির্লজ্জের মতো ভারতবর্ষে গিয়ে সেটিকে অস্বীকার করলেন। এই যে অস্বীকৃতির রাজনীতি, এটা বরং আমাদের দেশে যারা সনাতন ধর্মের মানুষ, অন্য ধর্মের মানুষ, তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।
আমাদের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করতে হবে, দোষীকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। অথচ একটি বিচারও আমরা দেখছি না। মানুষ ধর্মান্ধ হয়ে যাচ্ছে, রাষ্ট্র চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর বিষয় নিয়ে অনেকে পুলিশের কথা বলছেন। কিন্তু যে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল পোশাকের ভেতর দিয়ে সেও একজন ধর্মান্ধ। ওই পুলিশের পোশাক না থাকলে সে হয়তো জুতার মালা নিজেই পরিয়ে দিতো। কাজেই পুলিশের প্রতি কোনো আস্থা কিন্তু আমাদের থাকছে না। যে যার জায়গা থেকে, ছাত্র-শিক্ষক- সাংবাদিক, আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে আসা। নইলে এমন একদিন আসবে যখন তারা আপনাকেও জুতোর মালা পরাতে আসবে এবং তখন আপনি প্রতিবাদের কাউকে পাবেন না।
দেশের প্রায়ই কোথাও না কোথাও শিক্ষকরা কমিটির সদস্যদের হাতে, কিংবা রাজনৈতিক কোনো নেতার হাতে, তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে, অভিভাবকের হাতে এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
চলতি বছর ৩০ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে বহিঃপরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আগত অন্য কলেজের কয়েক শিক্ষক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধানের সম্মানে বিভাগের পক্ষ থেকে ছোট পরিসরে খাবারের আয়োজন করা হয়। ওই খাবার অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেয়ায়, একটি ছাত্র সংগঠনের কলেজ শাখার সভাপতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ২০-২৫ কর্মীসহ বাংলা বিভাগে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে বাংলা বিভাগের একজন প্রভাষককে লাথি ও কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। এ ব্যাপারে পুলিশ মামলা নেয়নি।
পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেয়ার অপরাধে হেনস্তা করা হয়েছে বহু শিক্ষককে। এসব ঘটনায় ছুরিকাঘাতও করেছে শিক্ষকদের। এসব ক্ষেত্রে মামলাও করা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে হার মেনেছে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণের বিষয়টি। এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ইতোমধ্যেই শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মান ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরে গেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ