উত্তর ইতালির ‘প্রাণভ্রমর’ ছিল ৬৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পো নদীটি। তুরিন, ক্রেমোনা, পিয়াসেঞ্জা এবং ফেরারা শহরের ভেতর দিয়ে কলকল শব্দে বয়ে যাওয়া দেশের দীর্ঘতম সেই নদীটি খরার কবলে পড়ে এখন মৃতপ্রায়। কোথাও কোথাও সুদীর্ঘ এলকাজুড়ে শুধু ধু ধু মরুভূমি।
যে নদীটির পাড়ে ঘুরে ঘুরে বাড়ন্ত ঘাস খেয়ে প্রশান্তির জাবর কাটতো গবাদি পশুরা, ফেটে চৌচির হওয়া সেই পাড়ের মাটি এখন পোকাদেরও বসবাসের অযোগ্য। কিছু এলাকায় পানি থাকলেও তা হাঁটু-সমান।
স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, কিছু দিনের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যাবে ৫০০ মিটার চওড়া পো নদী। গার্ডিয়ান। শুষ্কতম শীতকাল থেকে শুরু হওয়া খরা ম্লান হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। তারই প্রভাবে উত্তর-পশ্চিমে আল্পস থেকে আসা নদীটি একসময় ইতালীয়দের জন্য ছিল আশীর্বাদ।
কিন্তু বর্তমানে এর অস্বাভাবিকভাবে নিম্ন পানির স্তর এটিকে পরিণত করেছে ফসলের খেতে-যেখানে টমেটো আর তরমুজের উৎপাদন শুরু করেছেন স্থানীয় চাষিরা।
পানি শুকাতে শুকাতে নদীটির গুয়ালটিরি এলাকায় জেগে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডুবে যাওয়া ৫০ মিটারের একটি কার্গো। এটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন আশপাশের বাসিন্দারা। মান্টোভার কাছাকাছি শুকনো ওই নদীর মাঝামাঝি পাওয়া গেছে একটি জার্মান ট্যাংক এবং একটি প্রাচীন গ্রামের ধ্বংসাবশেষ।
ইতালিতে খরাপরিস্থিতি এতটাই তীব্র যে, লম্বার্ডি, পিডমন্ট, ভেনেটো এবং এমিলিয়া-রোমাগনার নেতারা সম্প্রতি অঞ্চলটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। কিছু উত্তরের শহরগুলোতে ট্রাকের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। জলাধারের স্তর পুনরুদ্ধার করার জন্য ১২৫টি শহরে পানীয় জলের রেশন সরবরাহের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, নদীর গভীরতা বর্তমানে ২.৭ মিটার পর্যন্ত পাওয়া গেছে। পো উপত্যকা ২০০৭, ২০১২ এবং ২০১৭ সালে খরার সম্মুখীন হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন এটি জলবায়ু সংকটের ক্রমবর্ধমান প্রভাবেরই প্রতিফল।
অথচ এই উপত্যকা ইটালির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এলাকা-যা তুরিন, মিলান এবং ব্রেসিয়ার মতো শিল্প কেন্দ্রগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমর্থন জোগায়। এটি ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষি অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। পো শুকিয়ে যাওয়ায় নদীটির পাড় ঘেঁষে বসবাস করা ছোট ছোট সম্প্রদায়গুলোর বিপদ আরও ঘনীভূত হলো।
খরা এখন গোটা ইউরোপের কপালের ভাঁজে পরিণত হয়েছে। গত ৭-৮ বছর ধরে ইউরোপে খরা লাগাতার ভাবে যতটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে, তা গত ২ হাজার বছরে একটি রেকর্ড। গোটা ইউরোপ মহাদেশে বেড়েছে তাপপ্রবাহের ঘটনা ও তীব্রতা বহু গুণ। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্যই এটা হয়েছে। যার জন্য দায়ী মানুষ।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্র এই উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আম্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার জিওসায়েন্স’-এ।
পৃথিবীর গত ২ হাজারের বছরের গড় তাপমাত্রার ধারা বুঝতে গবেষকরা রোমান সাম্রাজ্যের সময়ের ১৪৭টি ওক গাছের ২৭ হাজার গুঁড়ির রিং (বলয়) পরীক্ষা করেছিলেন। গাছের গুঁড়িতে একটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে তার চার দিকে উত্তরোত্তর বড় ব্যাসের যে বলয় দেখা যায়, তার সংখ্যার নিরিখেই গাছের বয়স নির্ধারণ করা হয়। তাপমাত্রা বাড়া-কমার সঙ্গে সঙ্গে সেই বলয়গুলির আকার ও একটি থেকে পরেরটির দূরত্ব বেড়ে যায়।
গবেষণাপত্রটি জানিয়েছে, ২০১৪ সালে যে ভাবে লাগাতার তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও ঘটনার সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে গোটা ইউরোপে তাতে তুলনায় অল্পবয়সিদের মৃত্যু, ফসল নষ্টের পরিমাণ ও দাবানলেরও সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে উদ্বেগজনক ভাবে। বেড়ে চলেছে।
২০১৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার এই ঊর্ধ্বগতি খতিয়ে দেখেছেন গবেষকরা। তবে তার পরেও ২০১৯, ২০২০ এবং চলতি বছর খরা ও তাপপ্রবাহ বেড়েছে।
গবেষকদের অশনি সংকেত, গোটা ইউরোপেই এই খরা ও তাপপ্রবাহ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে ফি বছর। ঘটনার সংখ্যাও বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে।
এ-ও দেখা গিয়েছে, গত ২ হাজার বছরে মধ্য ইউরোপের গ্রীষ্ম ক্রমশই আরও বেশি পরিমাণে শুষ্ক হয়ে উঠেছে। আর্দ্রতার পরিমাণ আগের চেয়ে অনেকটাই কমে গিয়েছে গ্রীষ্মে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠা বা সৌরচক্রের চরিত্রের পরিবর্তন এর জন্য দায়ী নয়। এর প্রধান কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। যার জন্য দায়ী মানুষই। গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনের মাত্রার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। অন্য কারণটি পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণনের সামান্য কিছু পরিবর্তন।
আধুনিক সময়ের বিশ্বের গড় তাপমাত্রার হেরফের বুঝতে এখনকার ওক গাছগুলির গুঁড়ি পরীক্ষা করেছিলেন গবেষকরা। মধ্যযুগের সময়টাকে বুঝতে তাঁরা নদীর তলদেশে থাকা ওক গাছের অবশেষ পরীক্ষা করেছিলেন। আর রোমান সাম্রাজ্যের সময়কার গড় তাপমাত্রার পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে গবেষকরা সেই কূপগুলি পরীক্ষা করেছিলেন যেগুলি অতীতে ওক গাছ দিয়েই বানানো হয়েছিল।
অন্যতম গবেষক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উল্ফ বুনজেন বলেছেন, ‘‘আমরা গত ২ হাজার বছরের মধ্যে এক অবিশ্বাস্য ও উদ্বেগজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি।’’
এসডব্লিউ/এসএস/১২২৪
আপনার মতামত জানানঃ