ডিজিটাল আইন তো আছেই, এবার যুক্ত হচ্ছে নিত্য নতুন জরিমানা। আজ সোমবার (২০ জুন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রেস কাউন্সিল আইন (সংশোধন) ২০২২- এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’য় জড়িত গণমাধ্যম আউটলেটকে জরিমানা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে প্রেস কাউন্সিলকে।
সভাশেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ‘অপসাংবাদিকতার জন্য খসড়া এ আইনে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আগে প্রেস কাউন্সিল শুধু তিরস্কার করতে পারত।’ সকল প্রিন্ট ও ডিজিটাল সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে আইনটি প্রযোজ্য হবে বলে এসময় উল্লেখ করেন তিনি।
এর পাশাপাশি সাংবাদিকেরা অন্যায় করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রেখে আরও একটি আইন হচ্ছে। আইনের খসড়া এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আছে। আগামী সংসদেই তা পাস হতে পারে।
শুধু আইন নয়। গণমাধ্যমই গণমাধ্যমের শত্রু হয়ে উঠেছে। নিজেদের পাশে নিজেরা না দাঁড়িয়ে, স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কণ্ঠরোধ কিংবা নিষিদ্ধের চেষ্টা করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে- বর্তমানে আমরা দেখছি, কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক গণমাধ্যমের আরেকটি অংশ সংবাদপত্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন।
টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো) তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছে, সংবাদপত্রগুলো যেন ভিডিও অনুষ্ঠান ও মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট প্রচার করতে না পারে।
অ্যাটকো যে দাবি জানিয়েছে, তা সংবাদপত্র শিল্পের বড় ধরনের ক্ষতি করবে এবং এই খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থিতি ছাড়া আগামী দিনে কোনো সংবাদপত্রের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
পৃথিবী বদলে গেছে, একই সঙ্গে গণমাধ্যমের পরিসরও। আজকের দিনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক সেই বিষয়ে সবশেষ সংবাদ জানতে চান। তারা এসব সংবাদের বিশ্লেষণ, ঘটনার পটভূমি এবং একইসঙ্গে সচিত্র বিবরণও চান। তারা শুধু তাদের প্রিয় প্রতিবেদক বা কলাম লেখকের লেখা পড়তে চান না, তাদের কথা শুনতে চান, দেখতে চান এবং যোগাযোগও করতে চান। সেটা শুধু ইন্টারনেট ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব।
বিশ্বের স্বনামধন্য সংবাদপত্রগুলো সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্ষেত্রে সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়া স্টোরির জন্য সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করে। সিএনএন, আল-জাজিরা, বিবিসির মতো কয়েকশ টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসও ইউক্রেন যুদ্ধের অডিও-ভিডিও সংবাদ প্রচার করছে। টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি মার্কিন সংবাদপত্রগুলোও সম্প্রতি সেদেশে সংঘটিত বন্দুকধারীর হামলায় হতাহতের ঘটনা প্রিন্ট ও ভিডিও আকারে প্রচার করেছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডতে কনটেইনার টার্মিনালে আগুনের ঘটনার কথাই ধরুন। আমরা সবাই এই ঘটনাটি বিভিন্নভাবে কাভার করেছি। টিভি চ্যানেলগুলো অনলাইনে লিখিত প্রতিবেদন আপলোড করেছে। পাশাপাশি আমাদের সংবাদপত্রগুলো একইসঙ্গে মুদ্রণ ও ভিডিও আকারে সংবাদ প্রচার করেছে। পৃথিবীর কোথাও কোনো সম্প্রচার সংস্থা ভিডিও কভারেজের কারণে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে এমন নজির নেই।
ইউরোপ, জাপান, এশিয়া কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রকেই ধরুন, সব জায়গায় একই চিত্র দেখতে পাবেন। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, দ্য টেলিগ্রাফ, পাকিস্তানের দ্য ডন, থাইল্যান্ডের দ্য ব্যাংকক পোস্ট, ইন্দোনেশিয়ার দ্য জাকার্তা পোস্ট, মালয়েশিয়ার দ্য স্টার—আমি সারাদিন ধরে বিভিন্ন পত্রিকার নাম বলে যেতে পারব যারা সুপ্রতিষ্ঠিত পত্রিকা এবং তাদের অত্যন্ত দক্ষ ও আকর্ষণীয় অডিও-ভিজুয়াল টিম ও কন্টেন্ট রয়েছে।
তাহলে অ্যাটকো কেন এ ধরনের দাবি জানাচ্ছে? এর ফলে কি বিশ্বের, এমনকি এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো পিছিয়ে পড়তে ভূমিকা রাখবে না?
অ্যাটকো কী এটাই ভাবছে যে, সংবাদপত্রগুলো ভিডিও কন্টেন্ট প্রচার করায় তাদের দর্শক কমছে? না, তারা দর্শক হারাচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলের কারণে। বিশেষত, বাংলা চ্যানেলগুলো। বহু বছর ধরেই আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এ সম্পর্কে অবগত আছে, কিন্তু তারা এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তেমন কিছুই করেনি।
অ্যাটকো যখন ‘ক্লিন ফিডের’ দাবি জানালো, আমরা তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলাম। কারণ এটি তাদের ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ছিল। সর্বোপরি, আমরা অনুধাবন করি টিভি চ্যানেলগুলোর আর্থিকভাবে লাভ করার দরকার রয়েছে।
কিন্তু তারা এখন সংবাদপত্রের ‘কন্টেন্টে’র বিষয়ে আঘাত হেনেছে, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি আমাদের সংবাদমাধ্যম ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি আঘাত।
অ্যাটকো জানিয়েছে, ভিডিও প্রচার করা সংবাদপত্রের ডিক্লেয়ারেশনের (সংবাদপত্র প্রকাশের প্রাথমিক অনুমতি) সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ডিক্লেয়ারেশনগুলো ডিজিটাল যুগের আগে দেওয়া এবং সেই কারণে দেশের ভবিষ্যৎ স্বার্থ রক্ষায় এগুলোর পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি আরও কতগুলো আইনের সংস্কার প্রয়োজন, যেগুলো বহু বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছিল। একটি প্রগতিশীল দেশ হিসেবে, ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সেই অনুযায়ী আমাদের বিভিন্ন আইনের পরিবর্তন দরকার।
অ্যাটকো একটি ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে অনলাইন নিবন্ধন নীতিমালার আওতায় কী রয়েছে, সে বিষয়ে তাদের অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমরা যতদূর বুঝি, আলাদাভাবে অনলাইন ভার্সনের জন্য নিবন্ধন করা হলে সংবাদপত্র একই সঙ্গে সংবাদ ও মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট প্রকাশের অনুমতি পায়। নীতিমালাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে অনুধাবন করা যায়, সংবাদপত্র যদি তাদের অনলাইন ভার্সনের জন্য বিশেষ নিবন্ধন নেয়, তাহলে তারা একইসঙ্গে ভিডিও কন্টেন্ট প্রকাশেরও অনুমতি পায়।
এখন পর্যন্ত আমরা ডিজিটাল খাতে যে বিপ্লব দেখেছি, তা আমাদের গণমাধ্যমের কার্যধারা ও ব্যবসায়িক মডেলে পুরোপুরি রূপান্তর ঘটিয়েছে। ভবিষ্যতের উদ্ভাবনগুলো একে আরও বেশি প্রভাবিত করবে। এটি সব ধরনের গণমাধ্যমের জন্যই প্রযোজ্য, বিশেষত প্রিন্ট। পাঠকের পছন্দ, মূল্যবোধ, চিন্তাধারা এবং কখন কতটুকু ও কীভাবে পড়বেন সেই অভ্যাসে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। সেই অনুযায়ী প্রিন্ট মাধ্যমকে আরও উদ্ভাবনী হতে হবে। পাঠক এখন নতুন ও ভিন্নধর্মী বিষয়ের ওপর পড়তে চান এবং সেগুলোও বিভিন্ন ফরম্যাটে। অনেক মানুষ বই পড়ার পরিবর্তে সেগুলো শুনতে পছন্দ করেন। ফলে অডিওবুক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমাদের অনেক পাঠক সংবাদ পড়ার চেয়ে শুনতে বেশি আগ্রহী। তাদের জন্য আমরা মুদ্রিত সংবাদের পাশাপাশি পডকাস্ট চালু করেছি।
ভবিষ্যতের সংবাদপত্রগুলোকে এমন হতে হবে যেন সেগুলো শুধু সংবাদপত্র নয়, বরং সংবাদ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। তাদেরকে পাঠকের কাছে বিভিন্ন উপায়ে পৌঁছাতে হবে। যার মধ্যে প্রিন্ট, অনলাইন, মোবাইল ফোন, পডকাস্ট ও মাল্টিমিডিয়া অন্যতম। এটাই হচ্ছে সেই ভবিষ্যৎ, যাকে আলিঙ্গন করে আমাদের টিকে থাকতে হবে। এরকম কিছু সংবাদপত্র ইতোমধ্যে চালু আছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ