ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের বিস্ময় দেখে যুক্তরাষ্ট্রও ‘প্রায় বিস্মিত’। কারণ, র্যাবের কর্মকাণ্ডে মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছর ধরে আলোচনায় তুলেছে।
পাশাপাশি র্যাবের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের বিস্তৃত সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। শুক্রবার সন্ধ্যায় মার্কিন দূতাবাসের নতুন অনুষ্ঠান অ্যামটকে পিটার হাস এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারভিত্তিক এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন পর্বে পিটার হাসকে প্রশ্ন করেন দূতাবাসের মুখপাত্র কার্লা টমাস।
রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নির্বাচন, ভবিষ্যৎ সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। তার মতে, যে বিষয়গুলোতে দুই পক্ষের মতপার্থক্য রয়েছে, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হলে তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা বাঞ্ছনীয়।
দুই দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে পিটার হাস বলেন, তার মনে হয়, লোকজন র্যাবের নিষেধাজ্ঞার ওপর খুব বেশি মাত্রায় মনোযোগ দিচ্ছেন। তারা চলমান অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন। আইন প্রয়োগ, সন্ত্রাসবাদ দমন ও সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা রয়েছে। এসব বিষয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতা রয়েছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা বিচার বিভাগ, আইনজীবী ও পুলিশের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকি। এই যে এত প্রশিক্ষণ ও অংশীদারত্ব আমরা করছি, সামনের দিনগুলোতে তা চালিয়ে যেতে এবং আরও গভীর করতে আমরা খুবই আগ্রহী। তবে এটা ঠিক যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের বিষয়টি আছে। যেখানে গত ডিসেম্বরে আমরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। তার পর থেকেই আমরা অনেকবার শুনেছি যে বাংলাদেশ এতে কত অবাক হয়েছে। সম্ভবত তাদের এই বিস্ময় দেখে আমরাও প্রায় বিস্মিত।’
বিস্ময়ের কারণ ব্যাখ্যায় পিটার হাস বলেন, ২০১৮ সালেই যুক্তরাষ্ট্র র্যাবকে প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধ করেছিল। এটা করা হয়েছিল মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ থেকে। বেশ কয়েক বছর ধরেই তাদের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এসব উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসব তুলে ধরা হয়েছে। ফলে নিষেধাজ্ঞাটা বিস্ময় হিসেবে এলেও যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বেগ ছিল, সেটি নিয়ে তো বিস্ময় থাকার কথা নয়।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব ও সংস্থাটির সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর গত বছরের ১০ ডিসেম্বর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
এ নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, সে বিষয়ে অনেকের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় বলে জানান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু তাদের বলি, এমন হতে হবে, আমি তা মনে করি না। আমাদের মধ্যে অনেক বিস্তৃত ক্ষেত্রে যেখানে আমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করি, এটি তার একটি।’
পিটার হাস বলেন, দুই দেশের সম্পর্কে অনেক বিষয়ে দ্বন্দ্ব আছে। এতটা গভীর ও বিস্তৃত সম্পর্কের মধ্যে এ ধরনের দ্বন্দ্ব থাকাটা স্বাভাবিক। র্যাবসহ প্রতিটি বিষয়ে একসঙ্গে বসা ও কথা বলা—এই ইস্যুটি সমাধানের জন্য কী করতে হবে। সেখানে হয়তো আমরা আমাদের চাওয়াটা বললাম আর বাংলাদেশ সরকারও বলল যে না, আমরা এটা করতে পারব না। সার্বভৌম দেশ হিসেবে তা–ও ঠিক আছে। এরপরও আমরা সম্পর্ক এগিয়ে নেব এবং এমনও বিষয় আছে, যেখানে আমরা চাইব আর তারা বলবে, না, আমরা এটা করতে পারব না। তারপরও সম্পর্ক এগিয়ে যাবে।
আলাপচারিতায় বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কাছে। রাষ্ট্রদূত বলেন, তার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে মার্কিন গণতন্ত্রও নিখুঁত নয়।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর ব্যাপক আত্মমূল্যায়ন ও তর্কবিতর্ক হয়েছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে, তাদের কার্যপ্রণালি ও রীতিনীতি নিয়ে, তাদের জবাবদিহি নিয়ে। এটি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে লড়াই করতে হয়েছে, খোলামেলা বিতর্ক করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই। আবার জনগণ কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে দেখেছে। কারচুপির অভিযোগ এসেছে। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে। এগুলো সবই হয়েছে এটি নিশ্চিত করার জন্য যে গণতন্ত্র চলমান।
পিটার হাস বলেন, বাংলাদেশেও কিছু বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার কাজ করতে পারে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি এটিও স্পষ্ট করতে চাই যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পছন্দ নেই। নির্দিষ্ট কোনো দল বা ফোরামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। এটা যুক্তরাষ্ট্রের কাজও নয়। তবে বাংলাদেশের মানুষ যা দেখতে চায়, আমরা তা দেখতে চাই। সেটি হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক মানের একটি নির্বাচন হবে, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের পরবর্তী নেতাদের বেছে নিতে পারবে একটি অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক, সহিংসতাবিহীন ও দমন-নিপীড়নমুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।’
এই কথাটি শুনতে সহজ শোনালেও, এটা আসলে ততটা সোজা নয় বলে মন্তব্য করেন পিটার হাস। তিনি বলেন, ‘আমরা ঠিক এটাই খুব করে দেখতে চাই। তেমন কিছু ইঙ্গিত, কিছু সংকেতকে আমি স্বাগত জানাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাবে। আমার মনে হয়, এটা গুরুত্বপূর্ণ।’
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই দেশের মতপার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে পিটার হাস বলেন, ‘সবচেয়ে বড় ইস্যুগুলোর মধ্যে যেটা প্রায়ই বাংলাদেশ সরকার সামনে আনে, তা হলো জিএসপি সুবিধা আবার চালু করার অনুরোধ। রানা প্লাজা ধসের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা কেড়ে নিয়েছিল। আমরা বারবার বলেছি যে জিএসপি আবার শুরু করার আগে বাংলাদেশ শ্রমিক, শ্রম অধিকার, শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যবস্থায় নিয়েছে, এটা দেখতে চাই। দুভার্গ্যজনকভাবে বাংলাদেশ এখনো সেগুলো পূরণ করেনি। কিন্তু ক্রমাগতভাবে তারা জিএসপির বাধা তুলে নিতে বলছে।’
রাষ্ট্রদূত জানান, বাংলাদেশ যতক্ষণ পর্যন্ত না জিএসপি সুবিধার জন্য যোগ্য হচ্ছে, ততক্ষণ এটি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উন্নয়ন অর্থায়ন করপোরেশন থেকে তহবিল গ্রহণের অনুমতি পাবে না। নতুন উন্নয়ন অর্থায়ন করপোরেশন গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু কাজের জন্য। রাজনৈতিক ঝুঁকিবিমা প্রদান তার একটি ইকুইটিভিত্তিক অর্থায়ন, এটি প্রকল্পের জন্য ঋণভিত্তিক অর্থায়নও হতে পারে। সাধারণত এগুলো হয় বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প, রাস্তাঘাট, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা খাত, টিকা উৎপাদনসংক্রান্ত।
পিটার হাস বলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ—উভয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের অনেক কিছু করার আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উদ্বেগও আছে বাংলাদেশে এবং এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে তাঁরা কুণ্ঠিত নন। তবে এসব আলোচনা হতে হবে খোলামেলা এবং উপলব্ধি করতে হবে যে এসব নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
সম্পর্কে ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে পিটার হাস বলেন, ‘পরের ৫০ বছর কেমন হতে পারে, তা ভেবে আমি রোমাঞ্চিত। আমরা ততটাই দ্রুত যেতে তৈরি রয়েছি, যতটা বাংলাদেশ এই অংশীদারত্বকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। সহযোগিতার আরও অনেক ক্ষেত্র আছে, যেখানে আমরা কাজ করতে আগ্রহী। এর একটি নিরাপত্তা সহযোগিতা, সামরিক দিকে যেখানে আমরা অনেক যৌথ মহড়া করে যাচ্ছি বাংলাদেশ ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে, যেখানে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নেতৃত্বে রয়েছে গোটা বিশ্বে, যেখানে আমরা শিখতে পারি এবং তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজের মাধ্যমে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি বিশেষ অভিযান, দুর্যোগে মানবিক ত্রাণসহায়তা ও অন্য বিষয়গুলো। আমরা সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি নিয়েও কাজ করতে চাই।
এসডব্লিউ/এসএস/০৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ