চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন দুর্ঘটনা— এই মুহূর্তে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক বিভীষিকার নাম। এই আগুন দুর্ঘটনায় শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে স্বদেশভমি। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটির এমন কোন প্রান্ত পাওয়া যাবে না যে খানে এই আগুনের উত্তাপ স্পর্শ করেনি।
বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় যে নীতিমালা বা নিয়ম রয়েছে, তা মানা হতো না চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে। যে কারণে রাসায়নিকের কনটেইনারের পাশে রাখা হতো পোশাকসহ অন্য পণ্যের কনটেইনার। ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া সব শর্তও ডিপো কর্তৃপক্ষ পূরণ করেনি। অন্যদিকে ডিপো কর্তৃপক্ষ যে নীতিমালা মানছে না, সেই তদারকিও সরকারি সংস্থাগুলো ঠিকমতো করেনি।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দুটি নীতিমালায় থাকা বিভিন্ন শর্ত মানার পর কনটেইনার ডিপো পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হয়। দুটি নীতিমালাতেই বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার ‘আইএমডিজি কোড’ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মূলত বিপজ্জনক পণ্য থেকে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি অর্থাৎ সুরক্ষা নিশ্চিত করার পদক্ষেপের কথা বলা আছে এই কোডে।
আর নিরাপত্তার জন্য আইএসপিএস কোড (জাহাজ ও বন্দর স্থাপনার নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম) বাস্তবায়নও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার জন্য এই দুটি কোড ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, অগ্নি ও দুর্যোগবিমা, ডিপো থেকে বন্দরে পণ্য পরিবহনের বিমা বাধ্যতামূলক। শ্রম আইনও মানা বাধ্যতামূলক। ডিপোটি সব ধরনের ছাড়পত্র পেয়েছে।
তবে ছাড়পত্রের শর্ত পূরণ করার অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে ডিপো কর্তৃপক্ষ তা মানেনি। আগুন-বিস্ফোরণের পর সরকার গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটির প্রাথমিক অনুসন্ধান, দুর্ঘটনার আগে লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থার পরিদর্শন প্রতিবেদন ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ডিপো পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তত ১০ ধরনের ঘাটতি থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, বিএম ডিপোর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছাড়পত্রের আবেদনে রাসায়নিক পণ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। সেটি থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার শর্ত থাকত। আবার রাসায়নিক পণ্যবাহী কনটেইনারের কাছাকাছি পোশাকপণ্যের কনটেইনার ছিল। হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড বিস্ফোরক না হলেও এগুলো আলাদা রাখতে হয়।
আগুন নেভানোর জন্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ভেতরে জলাধার থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু জলাধার ছিল না। ডিপোর ভেতরে প্রতি ৫০০ বর্গফুট এলাকায় একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার (আগুন নেভানোর যন্ত্র) থাকা বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। এমনকি ফায়ার হাইড্রেন্টও (আগুন নেভানোর পানির লাইন) ছিল না। আগুন নেভানোর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মীও ডিপোতে ছিলেন না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ডিপোতে কনটেইনার পরিচালনার কার্যক্রম তদারকি করে। সংস্থাটির সর্বশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বিএম ডিপোর পরিচালন কার্যক্রমে ঘাটতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, স্ক্যানার, যন্ত্রপাতিসহ চার ধরনের ঘাটতি রয়েছে। বিস্ফোরণের পর এখন তদন্ত শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, ডিপোর যে সারিতে রাসায়নিকের কনটেইনার ছিল, তার পেছনে ছিল পোশাক ও অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার। নিয়ম অনুযায়ী, রাসায়নিকের কনটেইনার আলাদা জায়গায় রাখতে হয়।
চট্টগ্রাম নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ২৪ একর জায়গায় অবস্থিত বিএম কন্টেইনার ডিপো ২০১১ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির বাংলাদেশ অংশে মালিকানায় রয়েছে স্মার্ট গ্রুপ। এটির ধারণক্ষমতা চার হাজার ৩০০ কন্টেইনার।
এ ব্যবসায়িক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাঁশখালী উপজেলার বাসিন্দা মুজিবুর রহমান, যিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। তিনি ওই ডিপোর পরিচালকও।
তার বড় ভাই মুস্তাফিজুর রহমান বর্তমানে ডিপোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিএম কনটেইনার ডিপো একটি জয়েন্ট ভেনচার কোম্পানি। ২০১১ সালের মে মাসে চট্টগ্রামের প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডে তারা কার্যক্রম শুরু করে।
১১ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি রফতানি ও আমদানি কনটেইনারাইজড কার্গো থেকে পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের (স্টাফিং/আনস্টাফিং) কাজ করছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রফতানি ও আমদানিকৃত পণ্যের কনটেইনার ও খালি কনটেইনার রাখা হয় ডিপোটিতে।
ডিপোটিতে এ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ খালাস ও মজুতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণসহ সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল কি না সেই প্রশ্ন তুলছে বিভিন্ন মহল। আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগে থেকে জানানো হয়নি ডিপোটিতে কনটেইনার ভর্তি এমন সব ভয়াবহ রাসায়নিক পদার্থের বিষয়ে। এতে প্রশ্ন ওঠে কোম্পানিটির মালিকপক্ষের আন্তরিকতা নিয়ে।
এ ব্যবসায়িক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাঁশখালী উপজেলার বাসিন্দা মুজিবুর রহমান, যিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। তিনি ওই ডিপোর পরিচালকও।
৪ জুন রাতে বিএম ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সদস্যসহ দুই শতাধিক মানুষ। অগ্নিকাণ্ডে ডিপোর একাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে গেছে পণ্যবাহী অন্তত ১০০ কনটেইনার।
আগুনের উৎস সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস বা কোনো তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আগুন লাগার সময় ডিপোতে ৩৭ কনটেইনার হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড ছিল। এর মধ্যে ১২টি অক্ষত রয়েছে।
বিএম ডিপোর নিরাপত্তায় ঘাটতি থাকার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মুজিবুর রহমান দাবি করেন, সব বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।
ডিপো পরিচালনার জন্য মূল লাইসেন্স দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ২০১৬ সাল থেকে দুই দফা বিএম ডিপোর লাইসেন্স নবায়ন করা হয়। দুবারই মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি।
সর্বশেষ ২০২০ সালে মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার ৩ মাস ১৬ দিন পর লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ। নিয়ম না মানায় কাস্টমস কারণ দর্শানো নোটিশ দিলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না জানিয়ে ছাড় পান সে সময়। রাজস্ব বোর্ডের সহযোগী সংস্থা চট্টগ্রাম কাস্টমস মূলত শুল্কসংক্রান্ত বিষয়গুলো তদারকি করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকদিন পার হয়ে গেছে কিন্তু এখনও বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ আইন ভঙ্গ করে তিনি ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মতো দাহ্য পদার্থ বিশেষ কোনো অবকাঠামো ছাড়াই স্টোর করেছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের কাউকে জানানো হয়নি, এখানে দাহ্য পদার্থ আছে। তাহলে অগ্নিনির্বাপণের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হতো। এতগুলো প্রাণ আমাদের হারাতে হতো না। সময় এখন অসহায়ত্ব প্রকাশের নয় বরং সময় এখন সক্ষমতা বৃদ্ধির।
তারা বলেন, সময় এখন রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে এবং দুর্ঘটনা মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা না হলে আগুন দুর্ঘটনা নামক ফ্রাংকেনস্টাইন কেড়ে নেবে আরও তাজা প্রাণ, নিভে যাবে আরও অনেক প্রজ্বলিত আশার প্রদীপ।
কনটেইনার ডিপোর কার্যক্রম তদারকি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তর। এ ছাড়া বিনিয়োগ বোর্ড, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকেও ছাড়পত্র নিতে হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ডিপোর পরিচালন কার্যক্রম এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন কার্যক্রম তদারকি করে।
বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনা তদারকি করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও পরিবেশঝুঁকি তদারকি করার কথা ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদপ্তরের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তদারকির জন্য অনেকগুলো সংস্থা থাকলেও সমন্বয় নেই। বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক কোডগুলো এখানে কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে জন্য আমাদের নিজস্ব নীতিমালা দরকার ছিল, সেটি হয়নি।
আইনগুলোও যুগোপযোগী হয়নি। তাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সব সংস্থার সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক বিধিবিধান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকারের জোরালো তদারকি প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৯
আপনার মতামত জানানঃ