স্ক্রিনের প্রতি আসক্তির কারণে শিশুরা দেরিতে কথা বলা শিখছে । তাই শিশুকে স্ক্রিন থেকে দূরে রাখা জরুরি। কিন্তু এই আধুনিক যুগে চারপাশে স্ক্রিনের ছড়াছড়ি, তাই চাইলেও শিশুদেরকে শতভাগ স্ক্রিনের সংস্পর্শ থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। তবে স্ক্রিন টাইম সীমিত করা সম্ভব।
দি আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স (AAP) তথা আমেরিকান শিশু বিশেষজ্ঞ একাডেমি থেকে জানানো হয়েছে, বাচ্চার ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত তাকে সবধরনের স্ক্রিন থেকে দূরে রাখতে হবে। বাচ্চার বয়স তারচেয়ে বাড়লে কিছু স্ক্রিন টাইম দেওয়া যেতে পারে। তবে বাচ্চার বয়স ২ বছর বা তার বেশি হলে তাকে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম দেওয়া যাবে।
AAP থেকে আরো বলা হয়েছে, শুধু এই সময় বেধে দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। বাবা, মাকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে সেই সময়টুকুতে বাচ্চা যা দেখছে সেটার মান যেন উন্নত হয়। বাচ্চারা যে শো দেখছে বা গেম খেলছে সেগুলো যেন তাদের ক্ষতির কারণ না হয়। বাচ্চাদের হাতে মোবাইল বা ট্যাব তুলে দিয়ে বাবা, মা নিজেদের মতো অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে চলবে না। বাচ্চা কী দেখছে বা কী খেলছে বাবা, মাকে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) থেকে বলা হয়েছে, বাচ্চার বয়স ২ বছর না হওয়া পর্যন্ত তাকে কোনো প্রকার স্ক্রিনটাইম দেওয়া যাবে না। বাচ্চার বয়স ২ বছর থেকে ৪ বছরের মাঝে থাকলে তাকে দিনে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম দেওয়া যেতে পারে।
নিরাপদ পদ্ধতিতে বাচ্চাকে প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি
সব বাবা, মা-ই চান তাদের সন্তান বড় হতে হতে প্রযুক্তি সচেতন হোক, প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখুক। আজকের সন্তানই হয়তো অনাগত ভবিষ্যতে সাড়া জাগানো প্রযুক্তি উদ্ভাবক হয়ে উঠবে। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, বাচ্চার হাতে প্রযুক্তি তুলে দেওয়া বা তাকে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শেখানোই শেষ কথা নয়, বরং তাকে প্রযুক্তি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে শেখাতে হবে।
বাবা, মাকে অন্য সব ক্ষেত্রের মতো এখানেও শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বাচ্চাকে শেখাতে হবে- প্রযুক্তির সাহায্যে কীভাবে জ্ঞান, বিজ্ঞান আদান-প্রদান করা যায়, কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যোগাযোগ স্থাপন করা যায়, কীভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় ইত্যাদি। কাজ করার জন্য যেমন বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রের প্রয়োজন হয়; প্রযুক্তিকেও তেমনটি একটি যন্ত্র বা একটি টুল হিসেবে ভাবতে শেখাতে হবে।
ধরা যাক, আপনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছেন। তখন বাচ্চাকে ফোন বা ট্যাবের সাহায্যে ম্যাপ দেখাতে পারেন, ম্যাপে তাকে দেখিয়ে দিতে পারেন আপনাদের গাড়ি কোন দিকে যাচ্ছে, আপনাদের গন্তব্য কোথায় ইত্যাদি। এভাবে আপনি নিজের সন্তানকে প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহার দেখিয়ে তার সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।
যদি আপনার সন্তান প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তর আগ্রহ দেখায়, যদি জানতে চায় প্রযুক্তি কোত্থেকে এসেছে, তাহলে তাকে পুরো বিষয়টা খুলে বলুন- কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, প্রোগ্রামার ইত্যাদি পেশায় জড়িত মানুষরা বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সেগুলো মানুষের ব্যবহার উপযোগী করার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। চাইলে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করে তুমিও তাদের মতো হতে পারবে।
আপনার সন্তানকে অবশ্যই বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করতে শেখাবেন, ভিডিও গেমস খেলতে দেবেন কিন্তু তাই বলে তাকে ঘরকুনো করে রাখবেন না। তাকে অবশ্যই বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলতে উৎসাহিত করবেন, তাকে একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন।
বাচ্চার স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল সমূহ
জলদি টেক ডিভাইস তুলে দেবেন না
বাচ্চার হাতে তাড়াহুড়ো করে, আগেভাগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস তুলে দেওয়ার জন্য চাপ নেবেন না। একটু দেরিতে ডিভাইস দিলে আপনার বাচ্চা তার সমবয়সী বাচ্চাদের চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে পড়বে না। তারা ঠিকই অল্প সময়ের মধ্যে মোবাইল ফোন কিংবা ট্যাব চালানো শিখে যাবে। তাই বাচ্চার হাতে অল্প বয়সে টেক ডিভাইস তুলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বাচ্চার জন্য নিজস্ব কোনো ডিভাইস কিনে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ ডিভাইসটি যদি আপনার বাচ্চার “নিজস্ব” না হয় তাহলে অভিভাবক হিসেবে আপনি খুব সহজেই সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
সীমারেখা বেধে দিন
নির্দিষ্ট করে দিন কখন এবং কোথায় স্ক্রিন দেখে বিনোদন নেওয়া যাবে। কোনো কোনো বাবা, মা নিয়ম করে দেন রাতের খাবার খাওয়ার আগে ৩০ মিনিট স্ক্রিন দেখা যাবে কিংবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্ক্রিন টাইমের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় বরাদ্দ রাখেন। এছাড়া আপনি চাইলে বাসার বিভিন্ন অংশকে স্ক্রিন-ফ্রি জোন হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন। অর্থাৎ, বাসার সেই স্থানগুলোতে কোনো মোবাইল, ট্যাব, টিভি দেখা চলবে না যেমন : বেডরুম, খাওয়ার টেবিল ইত্যাদি। স্ক্রিন-ফ্রি জোনের জন্য স্থান নির্ধারণ করার সময় খেয়াল রাখুন, সেই সব স্থানে যেন নিয়মটা পরিবারের সবার পক্ষে মানা সম্ভব হয়, সবাই যেন নিয়মটাকে সম্মান করতে পারে।
বাচ্চার সাথে কথা বলুন
বাচ্চাকে একাকী কোনো ডিভাইসের সামনে বসিয়ে দেবেন না। তার পাশে বসে আপনিও মনোযোগ দিয়ে খেয়াল রাখুন সে কী দেখছে বা কোন গেম খেলছে। তাকে তার দেখা কার্টুন বা গেমের ব্যাপারে কৌতুহলী হয়ে টুকটাক প্রশ্ন করুন। দেখুন সে কীভাবে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেয়। চাইলে আয়োজন করে সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন রাতের বেলা পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে, একটি সিনেমা দেখতে পারেন বা গেম খেলতে পারেন। তারপর সেটা নিয়ে বাচ্চার সাথে আলাপ করতে পারেন। কী দেখলেন, কেমন লাগলো, কোন অংশ বেশি মজার ছিল, কোন অংশ ভাল লাগেনি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনার সন্তান ধীরে ধীরে সোস্যাল মিডিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করলে তাকে নিরাপত্তা, প্রাইভেসি, ডিজিটাল আইন ইত্যাদির ব্যাপারে প্রাথমিক তথ্য ও পরামর্শ দিন।
মজার বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা করুন
যদি আপনার বাচ্চার নির্দিষ্ট সময়ের বেশি স্ক্রিন টাইম দাবি করে বা ডিভাইস নিয়ে থাকতে চায় তাহলে তাকে অন্য কোনো মজার কাজে যুক্ত করার চেষ্টা করুন।
নিজের ব্যাপারে সতর্ক হোন
বাচ্চারা দেখে শেখে। আপনি নিজে যদি সবসময় ফোন, কম্পিউটার, টিভি, ট্যাব ইত্যাদি নিয়ে পড়ে থাকেন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনি বাচ্চার স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও বাচ্চা আপনার কথা শুনবে না। কারণ আপনি নিজেই কোনো না কোনো ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত।
ডিভাইসগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিন
প্রযুক্তি সচেতন একজন মায়ের কথা বলি। তিনি তার পুরোনো ট্যাবে আগের সবকিছু আনইন্সটল করে তার ৩ বছর বয়সী ছেলের উপযোগী কিছু গেম ডাউনলোড করেছিলেন। কিন্তু ট্যাবটা তিনি সহজে বাচ্চার হাতে দিতেন না। যখন তার ছেলে বই, স্টিকার ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটাতে কাটাতে বিরক্ত হয়ে যেত তখন তিনি ছেলের হাতে ট্যাব তুলে দিতেন। আপনিও এই মায়ের কৌশলটি অনুসরণ করতে পারেন।
আপনার বাচ্চার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনাকে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ট্যাব/মোবাইল ইত্যাদি ডিভাইসে আপনার বাচ্চা যেসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে, সেগুলোর ইউজার নেম আর পাসওয়ার্ডগুলো আপনার দখলে আছে- এটা নিশ্চিত করুন। তাহলে সে কী কী ডাউনলোড করছে সে-ব্যাপারে আপনার স্পষ্ট ধারণা থাকবে এবং আপনি তার ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
পারিবারিক নিয়ম তৈরি করুন
পরিবারের সবাই কখন, কতটুকু সময় স্ক্রিন দেখতে পারবে বা ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবে সে-ব্যাপারে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম জারি করুন। তারপর সবার সুবিধার্থে নিয়মগুলো লিখে বাসার এমন কোনো জায়গায় টানিয়ে দিন যেন সবাই দেখতে পারে। নিশ্চিত হয়ে নিন- আপনার বাচ্চা নিয়মগুলো বুঝতে পেরেছে এবং সে মেনে চলতে রাজি হয়েছে। চাইলে নিয়ম লেখা কাগজের নিচে বাচ্চার স্বাক্ষর নিতে পারেন। এভাবে সে সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনের পাশাপাশি স্বাক্ষর করে নিজের মত প্রদান করার মতো অফিসিয়াল একটি বিষয় সম্পর্কেও ধারণা পাবে।
সন্তানকে তার কর্মফল সম্পর্কে জানিয়ে রাখুন
নিয়ম লঙ্ঘন করলে তার পরিণতি কী হবে সে-ব্যাপারে সন্তানকে আগেই জানিয়ে রাখুন। অনেক অভিভাবক শাস্তি হিসেবে বাচ্চার কাছ থেকে ডিভাইসটি কেড়ে নিয়ে থাকেন।
আপনি যদি সন্তানের সাথে কোনো ভিডিও বা দৃশ্যমান বস্তুর মাধ্যমে সময় কাটাতে না পারেন তাহলে অডিও বা শ্রবণযোগ্য কনটেন্টের দিকে নজর দিন। মোবাইলে একটা ছড়া চালু করে ডিভাইসটিকে বাচ্চার নাগালের বাইরে রাখতে পারেন কিংবা নিজেই একটা গান গেয়ে আপনার বাচ্চাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে পারেন।
তাদেরকে গল্প বলে শোনান। কবিতা, ছড়া, গল্প; এসব বাচ্চার শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। বাচ্চাকে খেলাধূলা করতে দিন, নিজেও তাদের সাথে খেলুন। খেলার মাধ্যমে বাচ্চাদের সৃজনশীলতা এবং কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পায়। খেলতে খেলতে বাচ্চা নতুন দক্ষতা অর্জন করে এবং তার আশেপাশে পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সংযোগ স্থাপন করে। বাচ্চাকে খেলনা ব্লক বিল্ডিং (শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্লাস্টিকের টুকরো দিয়ে খেলনা ভবন নির্মাণ), রোল প্লেয়িং (বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে খেলা) ইত্যাদি খেলার সাথে সম্পৃক্ত করে তাদের কল্পনাশক্তিকে জোরদার করার চেষ্টা করতে পারেন। তাদেরকে বাসার বাইরে নিয়ে যেতে পারেন। প্রকৃতি, বন, আকাশ, বাতাস ইত্যাদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। এভাবে তার ইন্দ্রিয়গুলো অভিজ্ঞতা অর্জন করবে এবং সে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
তথ্যসূত্র :
kidshealth.org
npr.org
আপনার মতামত জানানঃ