ভয়াবহ পানি সংকটে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ। নয়াদিল্লি, মহারাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এতে পানি সংকট আরও তীব্র হয়েছে। তবে এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নারীরা। প্রতিদিনই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পানি সংগ্রহে লড়াই করতে হচ্ছে তাদের।
খাবার পানির তীব্র সংকটে রীতিমত হাহাকার চলছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। পুকুর, টিউবয়েল কিংবা কূপ, কোথাও মিলছে না পানি।
সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে দেখা যায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কূয়ায় নেমে পানি তুলছেন এক নারী।
বাসিন্দারা বলছেন, গ্রীষ্মকাল আসলেই পানির সংকটে পড়তে হয় লাখ লাখ মানুষকে। প্রতিকারে রাজ্য সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয় না বলে অভিযোগ তাদের।
প্রতিদিন নিয়ম করে গভীর কূপে নেমে দুবেলা পানি সংগ্রহ করেন ভারতের মধ্যপ্রদেশের এক নারী। জীবন বাজি রেখে তার এমন সংগ্রামের ভিডিও রীতিমত ভাইরাল নেট দুনিয়ায়। খাবার পানির তীব্র সংকটে তার মতো আরও অনেকেই প্রতিদিন এমন ঝুঁকি নিচ্ছেন। এক কলসি পানির সন্ধানে হাঁটতে হয় গ্রামের পর গ্রাম। তবুও মেলে না পর্যাপ্ত পানি। কারণ, খরায় নেমে গেছে কূপ বা টিউবয়েলের পানির স্তর। শুকিয়ে গেছে পুকুরও। তারা বলছেন, রান্না তো দূরের কথা খাওয়ার পানিই জোগাড় হয় না।
যদিও মধ্যপ্রদেশের রাজ্য সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রত্যেকেটি গ্রামে মিলবে সাপ্লাই বা ট্যাপের পানি। অথচ, খাবার পানির জন্য লাখ লাখ মানুষের হাহাকার।
কয়েক সপ্তাহ ধরেই পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানাসহ আরও কয়েকটি রাজ্যে বিশুদ্ধ পানি তীব্র সংকট। মহারাষ্ট্রে পানির জন্য সড়ক পর্যন্ত অবরোধ করেছেন এলাকাবাসী।
গ্রীষ্মকাল শুরু হতেই দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে প্রতি বছরই দেখা দেয় তীব্র পানি সংকট। এ বছর তা আরও বেড়েছে। নয়াদিল্লি, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। সামান্য পরিমাণ পানি পেতে হেঁটে পাড়ি দিতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। তারপরও পানি মিলবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
খাবার পানির তীব্র সংকটে রীতিমত হাহাকার চলছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। পুকুর, টিউবয়েল কিংবা কূপ, কোথাও মিলছে না পানি।
সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, ভারতের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। তাতে পানি সংকট আরও চরম আকার ধারণ করেছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নারীদের। পানি সংগ্রহে প্রতিদিনই তাদের ছুটতে হয় এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। কখনো কখনো পানির পাত্র মাথায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়েও পথ চলতে হয় তাদের।
পানি সংকট মোকাবিলায় রাজ্যগুলোতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানির ট্যাঙ্ক পাঠানো হলেও তা নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। স্থানীয়রা বলছেন, দিনে দুই থেকে তিনবার আসে এসব পানি ভর্তি ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্ক থেকে পানি সরবরাহ করা হয় কুয়ার ভেতরে। সেখান থেকে রীতিমত যুদ্ধ করে পানি তুলতে হয়। যদিও কুয়া ভর্তি হওয়ার আগেই ফুরিয়ে যায় পানি। আবার এ পানির মান নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ।
অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও পানি সংকটের কারণে নারীদের পানি শূন্যতা ও হিট স্ট্রোকের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
স্বাধীনতার পর বিগত ৭৫ বছরে ভারতে মাথাপিছু পানির প্রাপ্যতা প্রায় ৭৫ শতাংশ কমেছে। দেশটির উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোতে এই সংকট আরও বেশি। ভারতজুড়েই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এই পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এ ছাড়া, অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—নদ–নদী শুকিয়ে যাওয়া, পানির উৎস কমে যাওয়া, বৃষ্টিপাতের হার কমে যাওয়া।
গ্রীষ্ম মৌসুমে দেশটির অধিকাংশ নদী–নালা শুকিয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালে যেখানে প্রতিবছর মাথাপিছু পানির প্রাপ্যতা ছিল ৬০৪২ ঘনমিটার সেখানে এই বছর সেটা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৪৮৬ ঘনমিটারে। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, দেশটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি পানির প্রাপ্যতাও কমেছে।
জাতিসংঘের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৫০০ কোটির বেশি মানুষ পানির সংকটে ভুগতে পারে।
এ নিয়ে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে পানি সম্পর্কিত দুর্যোগ যেমন খরা, বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত এই দুর্যোগে ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
সুপেয় পানি প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। নিরাপদ পানির অধিকারবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই আবার চরম দরিদ্র। প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাস করে গ্রামে। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নারী ও শিশুরা। এশিয়া ও আফ্রিকার সংকট ভয়াবহ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ