কোরআন অবমাননার অভিযোগে আফগানিস্তানের জনপ্রিয় মডেল আজমল হাকিকি এবং তার সঙ্গীকে আটক করেছে তালিবান। বুধবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এপি।
ফ্যাশন শো, ইউটিউব ক্লিপ আর মডেলিং ইভেন্টের কারণে তিনি আফগানদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। তালিবান সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ জেনারেল ডিরেক্টরেট অব ইন্টেলিজেন্স
মঙ্গলবার টুইটারে তাদের হাতকড়া পরা ভিডিও পোস্ট করেছেন। হাকিকি ইউটিউব এবং ইন্সটাগ্রামে তার কমেডি এবং ফ্যাশন ভিডিওর জন্য আফগানদের মধ্যে বিখ্যাত ব্যক্তি। তার সঙ্গে কাজ করেন গোলাম সাখি। তিনিও আটক হয়েছেন।
সাখিসহ চারজনের সামনে দাঁড়িয়ে হাকিকি বলেন, ‘আমি আফগান জনগণের কাছে, সম্মানিত আলেমদের কাছে এবং ইসলামিক আমিরাতের সরকারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’
ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভিডিওগুলোতে হাকিকি কোনো অপরাধের কথা স্বীকার করেননি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার এবং সাখির পোস্ট করা একটি সাম্প্রতিক ভিডিওর বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগ উঠেছে।
সেই বহুল প্রচারিত ভিডিওতে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভুগছেন বলে পরিচিত সাখির চরিত্রটির কৌতূকপূর্ণ কণ্ঠে আরবি শাস্ত্রের নকল পাঠ শুনে হাকিকি হাসাহাসি করেন। সাখি তার মজাদার এবং বিনোদনমূলক কথোপকথন শৈলীর জন্য পরিচিত।
হাকিকি বলেছেন, ‘সকল ইউটিউবার এবং গণমাধ্যমে সক্রিয় যুবকদের কাছে আমার বার্তা হলো ইসলামের পবিত্র মূল্যবোধ সম্পর্কিত যেকোন অবমাননা পরিহার করা।’
এদিকে আদালতে ইউটিউবারদের বিচার করা হবে কিনা বা সুনির্দিষ্ট বিচার করা হবে কিনা তা নির্দিষ্ট করে বলার জন্য তালিবান কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না।
তালিবান দাবি করে যে, তারা ইসলামিক আইন অনুযায়ী কঠোরভাবে শাসন করে। তারা ইসলামের সমালোচনা এবং ইসলামে অসম্মানজনক বলে বিবেচিত সবকিছুকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করে।
কী হচ্ছে আফগানিস্তানে?
তালিবানদের ঘোষণায় আফগানিস্তান এখন ইসলামিক আমিরাত। তাদের ভাষায় যার যা খুশি তাই করতে পারবে না। যার যা খুশি তা পরতে পারবে না। যার যেদিকে খুশি যেতে পারবে না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে তালিবান সরকারের ‘নীতি পুলিশ’। অন্ন-বস্ত্রের সংকটে সরকার নয়, ওপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করতে হবে।
এরই মধ্যে চীনের কক্ষপথে ঘুরছে আফগানিস্তান। কয়েক সপ্তাহ আগে কলকাতার কাগজে একজন অর্থনীতিবিদ লিখেছেন, আফগানিস্তানে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ থেকে সরে এসে ভারত আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লাভবান হয়েছে চীন-রাশিয়া।
শহর-গ্রামের হাটবাজার পাহারা দিচ্ছে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের ‘নীতি পুলিশ’। যদিও তাদের পোশাকে পুলিশ নয় বরঞ্চ অনেকটা খাদ্যনিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতো দেখাচ্ছে। তাদের কাজ, তালিবানের কট্টোরপন্থি নীতি অনুযায়ী আফগানিস্তানের নতুন ‘ইসলামিক’ পরিচয় নিশ্চিত করা। তারা এজন্য সব বিষয়েই নজরদারি করে। কোনো দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখেন তারা। আবার কোনো দোকানে নারীর ছবি সংবলিত পোস্টার থাকলে তাও সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছেন তারা।
সেদেশে বিদেশি সাংবাদিকদের বিষয়ে কড়াকড়ির মধ্যেও এরকম একটি নীতি পুলিশের দলকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে বিবিসি। ওই দলের সব থেকে কনিষ্ঠ সদস্য মাদরাসাছাত্র মাহমুদ ফাতিহ। ২৫ বছরের এই যুবক এক জনসমাবেশ লক্ষ্য করে ক্ষুদ্র বক্তব্য রাখছিলেন।
তার বক্তব্যের মূল বিষয় হচ্ছে, নিয়মিত নামাজ পড়া এবং পুরুষদের দাড়ি বড় রাখার গুরুত্ব। দাড়ি রাখা ইসলামে মহানবির আদর্শ এবং এর অনেক অন্য অনেক সুবিধাও আছে। তিনি তার সঙ্গে থাকা অন্য তালিবান সদস্যদের দেখিয়ে বলেন, তাদের সবার দুই বা তিনটি স্ত্রী আছে। তাই দাড়ি হচ্ছে শক্তিরও একটি উৎস।
শুধু বক্তব্য দেওয়াই নয়, তারা রাস্তাঘাটে কিংবা মার্কেটের নানা সমস্যা সমাধানেরও চেষ্টা করেন। এক দোকানদার অভিযোগ করেন যে, তালিবানের এক সদস্য তার কাছে বিনামূল্যে মোবাইল ফোন দাবি করেছে। তখন ওই তালিবান সদস্যদের ফোন নম্বর টুকে রাখেন ফাতিহ।
প্রতিশ্রুতি দেন, এ নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সব ধরনের বিষয়ে নজরদারি করলেও তাদের মূল কাজ হচ্ছে নারীদের পোশাক সম্পর্কে তালিবানের নতুন নীতির প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে তালিবান নির্দেশ দেয় যে, দেশের সব নারীকে অবশ্যই মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা পোশাক পরতে হবে। এছাড়া পুরুষ অভিভাবক ছাড়া কোনো নারীকে বাইরে পেলে তাকে জেলে ভরা হবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়।
মার্কেটের সামনে দুটি ছবি ঝুলানো হয়েছে, এতে দেখানো হয়েছে নারীদের কীভাবে পোশাক পরতে হবে। এর নিচে লেখা আছে, মুসলিম নারীদের অবশ্যই ইসলামিক পোশাক পরতে হবে এবং এটিই শরিয়ার নির্দেশ। আফগানিস্তান আগে থেকেই একটি রক্ষণশীল দেশ এবং দেশটির বেশিরভাগ নারী বোরকা পরায় অভ্যস্ত।
যদিও কাবুলের মতো শহরগুলোতে কিছু আধুনিক পোশাক পরিহিতা নারীদেরও দেখা মিলতো। তালিবান ক্ষমতা দখল করেই নারীর পোশাক নিয়ে নানা নীতি প্রণয়ন করতে থাকে। প্রথমে তারা হিজাব অনুমোদন করলেও এখন শুধু বোরকাকেই অনুমোদন দেওয়া হয়।
দিন দিন আরও কট্টর হয়ে উঠছে তালিবান। টেলিভিশনেও নারী সংবাদ পাঠিকাদের জন্য মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার নিয়ম করা হয়েছে নতুন করে। তালিবানের সদস্যরা বলেন, আমরা দেখলেই বুঝতে পারি কোন নারী পর্দা করছে আর কে করছে না।
যদি কোনো নারী পুরোপুরি তার সীমা অতিক্রম করে তাহলে আমরা তার পুরুষ অভিভাবককে খুঁজে বের করি। তাদের প্রশ্ন করা হয় যে, কোন অধিকারে তারা নারীদের এরকম পোশাক পরতে বাধ্য করছে? তারা বলেন, এটা কোনো সরকারের নির্দেশ নয়, এটা আল্লাহর নির্দেশ। যদি কোনো নারী তার মুখমণ্ডলই না ঢাকেন তাহলে পর্দা করার প্রয়োজনটা কী! বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে যদিও নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক নয়।
তালিবানের এই ইন্সপেক্টররা পিকআপ ট্রাকের পেছনে বসে শহর ঘুরে বেড়ান। তারা বিভিন্ন বাস থামিয়ে ভেতরের অবস্থা দেখেন। কোনো পুরুষ যাত্রী কোনো নারী যাত্রীর কাছাকাছি বসেছে কি না তা যাচাই করেন। কোনো নারী দাঁড়িয়ে আছেন কি না তাও দেখেন তারা।
সর্বশেষ তালিবান যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের সদস্যরা প্রায়ই সাধারণ নাগরিকদের মারধর করতো। এখন তাদের এরকম নির্দেশ নেই। কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা আছে। তারপর তার থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয় যে, তিনি আর এ ধরনের কাজ করবেন না। এরপর এক বা দুদিন পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তালিবান দিন দিন কট্টরপন্থি হয়ে উঠছে তা স্পষ্ট। কীভাবে নারীদের পোশাকের বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছে তালিবান। বোরকা পরার পরও অনেককে হুমকি শুনতে হচ্ছে। মুখমণ্ডল কাপড় দিয়ে না ঢেকে মাস্ক পরে থাকায়ও তালিবানের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে। তালিবানরা বলছেন, এটা আর আগের আফগানিস্তান নেই, এটি এখন একটি ইসলামিক আমিরাত।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ