ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী লেখম মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে এ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। অনেকেরই অভিযোগ এ আইন অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়রানির এবং অপব্যহারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসবের মধ্যেই প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাঙামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (০৭ জুন) সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাঙামাটি শহরের কাঁঠালতলি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সাংবাদিক ফজলে এলাহী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডসহ আরও কয়েকটি জাতীয় গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডটকম-এরও সম্পাদক।
কোতোয়ালি থানা সূত্রে জানা গেছে, ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। মামলার বাদী রাঙামাটির সংরক্ষিত আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনুর মেয়ে নাজনীন আনোয়ার। মামলার নম্বর ৮১৭/২২। সংবাদ প্রকাশের জেরে এই মামলা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ফজলে এলাহী দৈনিক কালের কণ্ঠ ও এনটিভির রাঙামাটি প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কবির হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ফজলে এলাহীর বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার আদালতে তোলা হবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটায় রাঙামাটি শহরের এডিসি হিল এলাকার নিজ বাসা থেকে ফজলে এলাহীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর তাকে কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয়। ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তারের পর কোতোয়ালি থানায় সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ ভিড় করেন।
রাঙামাটি কোতোয়ালি থানার ওসি কবির হোসেন বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাঙামাটি কোতোয়ালি থানা–পুলিশের কাছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮ এর আওতায় চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালের এক মামলায় প্রসেস নম্বর ৮১৭/২২ মূলে এলাহীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসে। পরোয়ানা আসার পর কোতোয়ালি পুলিশ তাকে কাঁঠালতলি গ্রেপ্তার করেছে। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’ মামলার বাদী নাজনীন আনোয়ার। তিনি রাঙামাটি মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংরক্ষিত সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনুর মেয়ে।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্মা (ওসি) কবির হোসেন বলেন, ‘আমরা এলাহীকে গ্রেপ্তার করেছি। আজ যেহেতু আদালতে তোলার সময় নেই সেহেতু আগামীকাল (বুধবার) তাকে রাঙামাটি আদালতে তোলা হবে। সেখান এলাহীর জামিন মঞ্জুর হবে নাকি চট্টগ্রামে পাঠানো হবে তা বিজ্ঞ আদালত আদেশ দেবেন। আদালতে তোলা না পর্যন্ত এলাহী পুলিশের হেফাজতে থাকবেন।’
পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট দেয় এটি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে আমি জানি। এর পরে কি করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশের সঙ্গে চিনু আপার মেয়ে ছিল। তাকে খুব এগ্রেসিভ মনে হয়েছে।’
জানা যায়, ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর অনলাইন পোর্টাল পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কম এ ‘রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পাইরেটস বিড়ম্বনা’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১২ ডিসেম্বর রাঙামাটির সাবেক সংরক্ষিত সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনুর জ্যেষ্ঠ মেয়ে নাজনীন আনোয়ার অভিযোগ দায়ের করেন।
এর একদিন পর ১৩ ডিসেম্বর ফিরোজা বেগম চিনু পৃথক আরেকটি অভিযোগে একই দাবি করে এলাহীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন।
ফজলে এলাহী সংবাদমাধ্যমকে প্রতিবেদককে বলেন, ‘২০২১ সালে ডিসি বাংলো পার্ক সংক্রান্ত এক নিউজের কারণে নাজনীন আনোয়ার রাঙামাটির আদালতে একটি অভিযোগ দেন। সেখানে প্রথম আসামি ছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ মামুন। আমাকে দ্বিতীয় আসামি করা হয়। এটি আদালত তদন্তের জন্য পুলিশের কাছে পাঠায়। পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট দেয় এটি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে আমি জানি। এর পরে কি করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশের সঙ্গে চিনু আপার মেয়ে ছিল। তাকে খুব এগ্রেসিভ মনে হয়েছে।’
পুলিশ জানিয়েছে, পুলিশের গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় রাঙামাটি কোতোয়ালি থানার একটি ডিডির কথা উল্লেখ আছে। যার নম্বর ৭৯৫। এ জিডি মূলে চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন নাজনীন আনোয়ার। যার মামলা নম্বর ২৮ / ২১। রাঙামাটি কোতোয়ালি থানায় ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর করা জিডিতে নাজনীন আনোয়ার অভিযোগ করেন, ‘ডিসি বাংলো পার্ক গ্রহীতাকে নিয়ে ফজলে এলাহী প্রচুর মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছেন যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮ মোতাবেক অপরাধ।’
এদিকে সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছে রাঙামাটি সাংবাদিক সমিতি, রিপোর্টার ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বুধবার মানববন্ধনের ডাক দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রিপোর্টার ইউনিয়নের সভাপতি সুশীল প্রসাদ চাকমা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে— এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
তারা বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
তারা বলেন, সারা বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী দেশ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৪২
আপনার মতামত জানানঃ