আমাদের সবারই ধারণা, আমাদের সব কিছু ভুল, আমেরিকা-ইউরোপের সব কিছু ঠিকঠাক। সব কিছু নিখুঁত। লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় হলে তো কথাই নেই, আমরা ধরে নেই পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আমাদের নিশ্চয়ই কোনো তুলনাই হতে পারে না। কিন্তু সেই আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা রাজনৈতিক এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি টেক্সাসের একটি স্কুলে চালানো হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ১৯ শিশু শিক্ষার্থীসহ ২১ জন। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীসহ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অন্যান্য স্টাফদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তথা বন্দুক তুলে দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত উত্তর আমেরিকার এই দেশটির ওহাইও অঙ্গরাজ্য শিক্ষকদের নিরাপত্তায় তাদের হাতে বন্দুক তুলে দেওয়ার একটি আইন কার্যকর করতে প্রস্তুত বলে জানানো হয়েছে। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায়।
যুক্তরাষ্ট্রে সংস্কৃতির লড়াইয়ে সামনের সারিতে রয়েছে বই, স্কুল এবং গ্রন্থাগার। কী পড়া হবে, কী শেখানো হবে এ নিয়ে রক্ষণশীলদের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে আন্দোলন। দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নানা ধরনের বই নিষিদ্ধের দাবি। খবর ডয়চে ভেলে।
এক কালো বাক্সভর্তি রঙিন বই নিয়ে নিজের রান্নাঘরে এসেছেন রবিন স্টিনম্যান। সেখান থেকে কয়েকটি বের করলেন তিনি। কাগজ সেঁটে বইগুলোর কিছু অংশ আলাদা করে চিহ্নিত করা রয়েছে। বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সি হর্স: দ্য শায়েস্ট পিশ ইন দ্য সি’, সেপারেট ইজ নেভার ইকুয়াল: সিলভিয়া মেন্দেস অ্যান্ড হার ফ্যামিলিজ ফাইট ফর ডিসেগ্রেগেশন এবং স্টোরি অব রুবি ব্রিজেস।
স্টিনম্যান মনে করেন, স্কুলের পড়াশোনায় কতটা গলদ রয়ে যাচ্ছে, এই পৃষ্ঠাগুলোই তার প্রমাণ। মামস ফর লিবার্টি নামে একটি সংগঠনের সভাপতি তিনি। এটি টেনেসি রাজ্যের উইলিয়ামসন কাউন্টিতে রক্ষণশীল বাবা-মায়েদের একটি সংগঠন। সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়বস্তু নিয়ে বাবা-মায়ের কথা বলার অধিকার নিয়ে কাজ করে এই সংগঠন। পাবলিক স্কুলে কিছু বই যেভাবে পড়ানো হয়, এ নিয়ে আপত্তি তুলেছে সংগঠনটি।
স্টিনম্যান বলেন, ‘‘স্কুল আমার সন্তানের ওপর কোনো আদর্শ চাপিয়ে দিতে পারে না। স্কুলে তাদের লিখতে এবং পড়তে শেখা, গণিত এবং বিজ্ঞান বোঝাতে হবে, যাতে তারা জীবনে উন্নতি করতে পারে। কিন্তু এই পাঠ্যসূচিতে একটা নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা হয়েছে, শিশুদের মধ্যে সেটি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
গত বছরের শেষদিকে মামস ফর লিবার্টি টেনেসি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনের কাছে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানায়। তাদের দাবি ‘বই এবং শিক্ষা উপকরণ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আমেরিকাবিরোধী, শ্বেতাঙ্গবিরোধী এবং মেক্সিকানবিরোধী এবং এসবের মাধ্যমে পক্ষপাতমূলক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে শিশুরা নিজের দেশ, নিজেকে এবং একে অপরকে ঘৃণা করতে শিখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে শ্রেণিকক্ষ এবং গ্রন্থাগার আবার মূল স্থান দখল করে নিয়েছে।
এই অভিযোগ অবশ্য খারিজ হয়ে গেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই রক্ষণশীলরা এমন নানা আন্দোলন শুরু করেছেন। বিশেষ করে বর্ণবাদ, লিঙ্গ এবং যৌনতাকে যেভাবে পড়ানো হয়, এ নিয়ে তাদের ব্যাপক আপত্তি।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে শ্রেণিকক্ষ এবং গ্রন্থাগার আবার মূল স্থান দখল করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে ২০২১ সালে, লাইব্রেরি, স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা উপকরণ ও সেবা নিয়ে ৭২৯টি চ্যালেঞ্জ হয়েছে। এর ফলে এক হাজার ৫৯৭টি বই সরিয়ে নিতে হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে এমন চ্যালেঞ্জগুলোর হিসাব রাখতে শুরু করেছে সংগঠনটি। এরপর থেকে ২০২১ সালের এই সংখ্যাই সর্বোচ্চ। এসব বইয়ের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ এবং এলজিবিটিকিউ লেখকদের লেখা অথবা তাদের সম্পর্কে লেখা।
অথচ যুক্তরাষ্ট্র লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের এক জরিপে দেখা গেছে যে দল নির্বিশেষে বেশিরভাগ আমেরিকান পাবলিক বা স্কুল লাইব্রেরি থেকে বই সরানোর পদক্ষেপের বিরোধী।
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু হার্টম্যান মনে করেন, (বই নিষিদ্ধ করা) মার্কিন ইতিহাসে একটি নিয়মিত ঘটনা এবং এর সঙ্গে সংস্কৃতির লড়াইয়ের বড় সম্পর্ক রয়েছে। এটি মার্কিন ইতিহাসেরও অংশ।
তিনি বলেন, মূলত ধর্মীয় রক্ষণশীল এবং সেক্যুলার উদারপন্থিদের এই লড়াই অনেক দিক থেকে সেই ১৯২০ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। কিন্তু ১৯৬০ এর দশক থেকে সামাজিক অধিকার, নারীবাদ, সমকামীদের অধিকারের মতো নানা আন্দোলনের ফলে এটি তীব্র মাত্রা পেয়েছে।
সেন্সরশিপ সংক্রান্ত এই লড়াই নতুন নয় এবং তা কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সীমাবদ্ধ নয়। জার্মানিতে নাৎসি সরকার নানা বইকে ‘সমাজের অধঃপতনের কারণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করেছিল, পুড়িয়ে ফেলেছিল, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে যাওয়া বই ধ্বংস করা হয়েছিল। বিশ্বজুড়েই ইতিহাসে বইয়ের ওপর এমন নানা খড়্গ নেমে এসেছে বারবার।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে এবারের এই ঘটনাগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ ক্রমশ তীব্রভাবে বিভক্ত হওয়া মার্কিন রাজনীতিতে এই আন্দোলনের দুপক্ষে রয়েছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থন।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণ সম্পর্ক গত ২০ বছরের হিসাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। গাত্রবর্ণের কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্য নিয়ে একবিংশ শতাব্দীর এ সময়েও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার।
২২ জুলাই বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গ্যালাপের জরিপে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, বর্ণ সম্পর্ক এখন নাজুক অবস্থায়। ৫৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান মনে করেন, শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সম্পর্ক এখন খারাপ। মাত্র ৪২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান মনে করেন, দুই বর্ণের লোকজনের মধ্যে এখনো সম্পর্ক ভালো বা মোটামুটি ভালো আছে।
বর্ণবিদ্বেষের মতো ঘটনা আইন করে নিষিদ্ধ রয়েছে এবং এ ধরনের বিদ্বেষের কারণে বহু মামলা হয়ে থাকে প্রতিবছর। কর্মক্ষেত্রে বা সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্যের ওপর প্রলেপ দেওয়া মার্কিন সমাজে মাঝেমধ্যেই এ নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য এবং এশীয় লোকজনের ওপর বিদ্বেষের অভিযোগ ওঠে অহরহ।
নাগরিক আন্দোলনের জের ধরে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বর্ণবিদ্বেষ অবসান এবং বর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থায় সমালোচনামূলক বর্ণবাদ ভাবাদর্শ নিয়ে পাঠ্যসূচি সাজানো হয়েছে। গত শতকের মধ্যভাগ থেকে মার্কিন নাগরিক আন্দোলনের প্রবর্তক এমন পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গদের ভয়ভীতির মধ্যে ফেলে এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানি আমেরিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থায় সমালোচনামূলক বর্ণবাদ নিয়ে পাঠ্যসূচির বিরোধিতা করছে রিপাবলিকান দলের রক্ষণশীল পক্ষ। এর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানি ও ইন্ধন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৮
আপনার মতামত জানানঃ