আমাদের অলক্ষে, সন্তর্পণে এক ভয়াবহ আসক্তি গ্রাস করছে শিশু-কিশোর প্রজন্মকে। এটা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত, বিকারগ্রস্ত করে তুলছে। এ এক নতুন নেশা—স্ক্রিন-আসক্তি।
অর্থাৎ স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি ইত্যাদির স্ক্রিন বা পর্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থাকার দুর্নিবার আকর্ষণই হলো স্ক্রিন-আসক্তি। অন্যান্য নেশা বা আসক্তি সন্তর্পণে-গোপনে চর্চিত হলেও স্ক্রিন-আসক্তির ঘটনা অভিভাবকদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের সামনেই ঘটছে। এটি একটি বাড়তি উদ্বেগের কারণ। আমরা বুঝতেও পারছি না, কী ভয়াবহ নেশার মধ্যে আমরা আমাদের সন্তানদের নিমজ্জিত করছি।
শিশুরা ফোন-কম্পিউটারে আনন্দময় সময় কাটাচ্ছে, তাতে আর ক্ষতির কী থাকতে পারে—এই সরল বিশ্বাসে আমরা তাদের হাতে এসব ভয়াবহ সামগ্রী তুলে দিচ্ছি। সময় দেওয়ার বদলে তাদের আমরা ফোন-ল্যাপটপ দিচ্ছি; কোনোরকমে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সময় পারের চেষ্টা করছি।
একবারও খেয়াল করছি না, এসব দিয়ে আসলে তারা কী করে? শিশু-কিশোরেরা স্ক্রিন-আসক্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এটা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত। আগে দেখা যাক স্ক্রিন-আসক্ত হওয়ার লক্ষণগুলো কী, তারা স্ক্রিনে কী করে আর স্ক্রিনের প্রতি তাদের আকর্ষণটাই–বা কেমন।
কী ক্ষতি হচ্ছে শিশুদের?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্ক্রিন-আসক্তির তিনটি লক্ষণ উল্লেখ করেছে। এগুলো হলো স্ক্রিন-আসক্ত ছেলেমেয়েরা ডিজিটাল গেম বা ভিডিও গেমের পক্ষে আত্মরক্ষামূলক কথা বলে; এটা যে একটি সমস্যা, সেটাই তারা স্বীকার করে না। তারা যে স্ক্রিনে আসক্ত, এটা প্রমাণসহ হাজির করলেও তারা তা মানতে চায় না।
আমেরিকান একাডেমি অব নিউরোলজি কর্তৃক প্রকাশিত ‘ব্রেইন অ্যান্ড লাইফ’ ম্যাগাজিনের ‘গেম থিওরি: দ্য ইফেকটস অব ভিডিও গেমস অন দ্য ব্রেইন’ শীর্ষক নিবন্ধে স্ক্রিন-আসক্তির ১০টি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো ফোনে বা কম্পিউটারের পেছনে অধিক সময় ব্যয়, ভিডিও গেম বিষয়ে কথা বললে তার পক্ষে অবস্থান, সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, বাস্তব বন্ধু ও পরিবারের চেয়ে ফোন-কম্পিউটারের সাহচর্য বেশি পছন্দ, আগের গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা শখে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও মেজাজ খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাওয়া, অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল বন্ধুদের নিয়ে নতুন জগৎ গড়ে তোলা, স্কুলের কাজে অবহেলা করা ও পরীক্ষার ফলাফল ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়া, অদ্ভুত কাজে অর্থ ব্যয় করা এবং গেম খেলা বা সহিংস ভিডিও দেখার বিষয়গুলো লুকাতে চাওয়া। তারা আলো-আঁধারিতে নিঃশব্দে থাকতে পছন্দ করে, সামান্যতেই অধৈর্য হয়ে যায়। এখন মিলিয়ে দেখুন, আপনার শিশু স্ক্রিনে আসক্ত কি না।
অধিকাংশ শিশু-কিশোর ফোন-কম্পিউটারে আসলে কী করে? তারা সাধারণত ফাইটিং গেম খেলে, মারামারি-ভাংচুর-সহিংসতায় ভরা অশোভন ও আক্রমণাত্মক ভিডিও দেখে। পাবজি, ফ্রি ফায়ার, ক্লাশ অব ক্লান বা এ–জাতীয় সহিংস লাইভ গেম খেলে। যাতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বহু গেমার সরাসরি অংশগ্রহণ করে, যা খেলায় বাড়তি উত্তেজনা আনে।
অনেকেই আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব গেম খেলার লাইভ স্ট্রিমিং করে, যা দেখে নতুনরা খেলার কৌশলগুলো রপ্ত করে। তাদের অবশ্য গেমার না বলে কলুর বলদ বলাই ভালো। কারণ, তারা গেম ডেভেলপারের বেঁধে দেওয়া ছকের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দিন পার করে; দিন শেষে পায় শুধু একরাশ ক্লান্তি আর অস্থিরতা। এখন দেখা যাক এসব সহিংস ও অশোভনীয় গেম এবং ভিডিও শিশু-কিশোরদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে।
‘আমেরিকান একাডেমি অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি’ কর্তৃক ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘ভিডিও গেমজ অ্যান্ড চিলড্রেন: প্লেয়িং উইথ ভায়োলেন্স’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ভিডিও গেম যারা বেশি খেলে, তারা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে চায় না, মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না এবং অসামাজিক হয়ে ওঠে। তারা পরিবারে, স্কুলের কাজে বা শখের পেছনে সময় দিতে চায় না। তারা পড়াশোনা কম করে; পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ করে। শারীরিক শ্রম বা ব্যায়ামকে অপছন্দ করে এবং পরিণামে মুটিয়ে যায়। তারা অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করে, কম ঘুমায়। তাদের ঘুমের মানও খারাপ। চিন্তাভাবনা এবং আচরণে তারা আক্রমণাত্মক ও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।
চীনে যেসব শিক্ষার্থী গেম খেলে আর যারা খেলে না, তাদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখে গেছে, গেম-খেলা শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে ‘গ্রে ম্যাটার’ কম, যা মস্তিষ্কের চিন্তন অংশ বলে পরিচিত। সাইকোলজি টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্ক্রিন-আসক্তি আমাদের মস্তিষ্কের গঠনই পরিবর্তন করে দেয়। ব্রিটিশ সাইকলজিক্যাল সোসাইটির মতে, স্ক্রিন-আসক্তি শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, এসব শিশু গেম বা ভিডিও দেখাকে অন্য সবকিছুর থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এর খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে বুঝিয়ে বলার পরও তারা এসব ছাড়তে পারে না। পরিবার বা সমাজ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। তাদের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেতে থাকে। এটা চোখের ক্ষতি করে, শারীরিক স্থবিরতার কারণে হাড়ের গঠনকে দুর্বল করে দেয়। নানা রকম রোগব্যাধি অল্প বয়সেই শরীরে বাসা বাঁধে।
স্ক্রিন–আসক্তি, বিশেষ করে ভিডিও গেম খেলা নিয়ে কিছু ভালো কথাও বলা হয়ে থাকে। নিয়ন্ত্রিত হলে এটা শিশুদের চিন্তাশক্তি, দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ, বিষণ্ণতা ও নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু আপনার পক্ষে কি সেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং বাস্তবায়ন সম্ভব? আর আপনি কতক্ষণ এ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবেন? ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গ, ইউটিউবের স্টিভ চেন ও জাভেদ করিম, গুগলের ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন এবং মাইক্রোসফটের বিল গেটস কিন্তু তাদের সন্তানদের এসব স্ক্রিন বা গ্যাজেট থেকে দূরে রেখেছেন। অধিকাংশ মা–বাবার মতো তাদের পক্ষেও এই নিয়ন্ত্রণ কঠিন ছিল।
সমাধান কী?
তাহলে কি আমরা আধুনিক জগতের এ অন্যতম অনুষঙ্গ স্মার্টফোন, কম্পিউটার, টিভি থেকে শিশুদের দূরে রাখব? এগুলোর সঙ্গে পরিচিতি না থাকলে কি আমাদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে পারবে? পারবে না। অবশ্যই তাদের এসব আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত হতে হবে। কিন্তু, কতটুকু আর কীভাবে? মনে রাখতে হবে, যে অস্ত্র চিকিৎসকের হাতে জীবনদায়ী, তা আবার দুর্বৃত্তের হাতে জীবন-সংহারী। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে থাকতেই হবে, কিন্তু তার ক্ষতিকর আসক্তি পরিহারের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। কীভাবে?
আপনার সন্তান কী খেলছে, কী দেখছে—সে ব্যাপারে অবশ্যই আপনার নজরদারি থাকতে হবে। দিনে এক-দেড় ঘণ্টার বেশি এসব ব্যবহার করা উচিত নয়। কিন্তু, ব্যস্ততার কারণে আপনি হয়তো এসব তত্ত্বাবধান করতে পারছেন না। এখন আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোনটা আপনার কাছে বেশি মূল্যবান—আপনার সন্তান, নাকি আপনার কাজ?
এ দুয়ের মধ্যে একটা সুষম ভারসাম্য আনতে হবে। শিশুরা যেন নিয়মিত খেলাধুলা, পারিবারিক কাজকর্ম, বইপড়া, বিভিন্ন বিষয়ে পারিবারিক আলোচনা এবং গঠনমূলক শখ চর্চার মাধ্যমে আনন্দময় সময় কাটাতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এসবের আনন্দ ধরিয়ে দিতে পারলে, তারা স্বাভাবিক জীবনে উৎসাহিত হবে।
স্ক্রিন-আসক্তির ক্ষতিকর দিকগুলো সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হবে, জোরজবরদস্তি করা যাবে না। শিশুদের নিষেধ করে নিজেরাই যদি আবার বাসায় এসব ব্যবহার করি, তাহলে তারা এসবে প্রলুব্ধ হবে। স্ক্রিনের বাইরে তাদের ভাললাগার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তানের শোবার ঘরে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি—এসব রাখা যাবে না।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার ন্যূনতম এক ঘণ্টা আগে বাড়ির সবাকেই এসব ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সন্তানদের সময় দিতে হবে; তাদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম ব্যয় করতে হবে। ক্ষতিকর গেম সাইটগুলো বন্ধ বা সীমিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে স্কুলের পাঠ্যক্রমে এসবের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রযুক্তি পরিহার নয়; তার উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ