দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা গোটা দেশ। এর মধ্যেই বাংলাদেশে আবাসিক খাতের জ্বালানি ও শিল্প কারখানায় সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ২২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। শনিবার এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও পহেলা জুন থেকে নতুন মূল্য কার্যকর হবে।
বিইআরসি জানিয়েছে, ভোক্তা পর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ঘনমিটারে ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২.৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১.৯১ টাকা পুনঃ নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন মূল্যহার অনুযায়ী এক চুলার গ্যাসের জন্য মাসে দিতে হবে ৯৯০ টাকা আর দুই চুলার জন্য দিতে হবে ১ হাজার ৮০ টাকা।
প্রিপেইড মিটারে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ টাকা, এটি আগে ছিল ১২.৬০ টাকা। আর সার কারখানায় সরবরাহ করা গ্যাসের জন্য প্রতি ঘনমিটারে দিতে হবে ১৬ টাকা। তবে সিএনজি গ্রাহকদের মূল্য হারে কোন পরিবর্তন আনা হয়নি।
বাংলাদেশে সর্বশেষ গ্যাসের মূল্য হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৯ সালে। তখন গ্যাসের পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ৭০ পয়সা।
এ বছরের শুরুতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসির কাছে প্রস্তাব পাঠায় পেট্রোবাংলা। কিন্তু শুরুতে সেটা বিধিসম্মত হয়নি জানিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। পরে সংস্থাটি আবার প্রস্তাব পাঠায়। তখন গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।
কোম্পানিগুলো তখন বলেছিল, বাংলাদেশের গ্যাস ক্রমেই আমদানি করা এলএনজি নির্ভর হয়ে ওঠায় মূল্য বৃদ্ধি ছাড়া বিকল্প নেই। এরপর ২১-২৪ শে মার্চ ওই প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি করে বিইআরসি।
বিইআরসি জানিয়েছে, পেট্রোবাংলার জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে প্রাপ্ত ৩,৩০০ কোটি টাকা, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর মুনাফার ২৫০০ কোটি টাকা এবং সরকারের প্রদেয় ভর্তুকির ৬০০০ কোটি টাকা বিবেচনায় রেখে ভোক্তা পর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ঘনমিটারে ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ২২.৭৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১১.৯১ টাকা পুনঃ নির্ধারণ করা হয়েছে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অবশ্য মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক। আবার কারও মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে দাম সমন্বয় করতে হবে।
কেউ কেউ জানিয়েছেন, এমনিতেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সব শ্রেণীর ভোক্তা ও শিল্প উদ্যোক্তারা নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে উদ্যোক্তারা মুনাফার মার্জিন কমিয়ে পণ্য রফতানি করছেন। ইতোমধ্যে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সবধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের দামও বেড়ে যাবে। এক দিকে গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলোর ব্যয় বাড়বে, একই সাথে বিদ্যুতের দাম বাড়বে, পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। পণ্যমূল্য আরো বাড়বে। এতে জনসাধারণের দুর্ভোগ যেমন বাড়বে, তেমনি উদ্যোক্তারাও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবেন বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ভাট-ট্যাক্সসহ নানাভাবে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কোন কোম্পানি কত ডিভিডেন্ট দিবে সেই সিদ্ধান্তও চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা মুনাফা তুলে দিচ্ছে আর কোম্পানিগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে গ্রাহকের কাছে টাকা চাইছে। কিন্তু মালিক হিসেবে সরকারের দায়িত্ব প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করা। কোম্পানিগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিতরণ মার্জিন বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
পেট্রোবাংলার সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসসঙ্কট কাটাতে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ভর্তুকির চাপ বেড়ে গেছে। এ চাপ সামলাতে গত ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরামর্শ দেয় আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল।
এরপর গত ৩ জানুয়ারি জ্বালানি বিভাগ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠানোর জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দেয়। পরে পেট্রোবাংলা থেকে আমদানি করা এলএনজি ও দেশীয় গ্যাসের দাম, ভ্যাট-ট্যাক্স, বিভিন্ন তহবিলের চার্জ ধরে একটা খসড়া হিসাব বিতরণ কোম্পানিগুলোতে ৫ জানুয়ারি পাঠানো হয়।
এরপর বিতরণ কোম্পানিগুলো নিজেদের আয়-ব্যয় হিসাব উল্লেখ করে প্রায় একই ধরনের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব কমিশনে পাঠায়। একই সাথে কোম্পানিগুলো নিজেদের পরিচালন ব্যয় (মার্জিন) বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দেয়।
দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের প্রস্তাবে বলে, এলএনজি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে দেশী-বিদেশী গ্যাস কেনা ও সরবরাহ, পরিচালন ব্যয়, ভ্যাট-ট্যাক্স ও নানা চার্জ মিলিয়ে ৬৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে বছরে ৮৭৮ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানিতে ৪৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটার এলএনজিতে ব্যয় ৫০ টাকা ৩৮ পয়সা, যার মধ্যে ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা ৬৯ পয়সা, আমদানি পর্যায়ে মূসক ৫ টাকা ৫০ পয়সা, অগ্রিম আয়কর ৭৪ পয়সা, ফাইন্যান্সিং ব্যয় ১ টাকা ৪৪ পয়সা, ব্যাংক চার্জ ও কমিশন ৫৯ পয়সা, রিগ্যাসিফিকেশন ব্যয় ১ টাকা ৮৬ পয়সা, অপারেশনাল ব্যয় ৫ পয়সা এবং ভোক্তা পর্যায়ে উৎসে কর ৩ টাকা ৫২ পয়সা (৭%)। দেশে কার্যরত বিদেশী গ্যাস কোম্পানির (আইওসি) গ্যাস কিনতে ব্যয় হবে প্রতি ঘনমিটারে ২ টাকা ৯১ পয়সা।
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফএল) ও বাপেক্সের পরিচালন ব্যয় ধরা হয় প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৮৭.৯৮ পয়সা, ৩৩.৮৩ পয়সা ও চার টাকা ৫৫ পয়সা। এ ছাড়া প্রতি ঘনমিটারে পরিচালন মার্জিন সঞ্চালন কোম্পানির (জিটিসিএল) ৮৬.৪৮ পয়সা, বিতরণ কোম্পানির ২৭.৪৯ পয়সা ধরা হয়।
প্রতি ঘন মিটারে পেট্রোবাংলার পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় পয়সা, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে ৪৬.১৪ পয়সা এবং জ্বালানি উন্নয়ন তহবিলে ৮৮.৭০ পয়সা চার্জ ধরা হয়। সরকারের হিস্যা হিসাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ