করোনাকালে বেড়েছে নারী উন্নয়নে বড় বাধা বাল্যবিবাহ, যা নারী নেতৃত্বের পথেও অন্তরায়। করোনাকালে স্কুলগুলো বন্ধ, কাজ না থাকা, যৌন সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায় বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়েছে। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাল্য বিয়ে আক্রান্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আলোচ্য অবস্থানে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিয়ের হার সর্বোচ্চ। প্রতিবছর প্রায় এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি ১৮ বছরের কম বয়সী কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ২৩টি কন্যাশিশুর, আর প্রতি দুই সেকেন্ডে একজনের।
বৈশ্বিক ব্যাপকতার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার পরই অবস্থান এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের।
সম্প্রতি ‘লাউডার দ্যান ওয়ার্ডস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশিত হয়।
এই প্রতিবেদনটি সাজানো হয়েছে বিশ্বব্যাপী প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় বাল্যবিয়ে এবং ক্ষতিকর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে এমন কয়েকজন ছেলে-মেয়ের জীবনের গল্প দিয়ে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৮০ কোটি মেয়ে বাল্যবিয়ের কুফলের শিকার হবে, যা বর্তমানে ৬৫ কোটি।
জানা যায়, বিয়ের জন্য বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে বয়স নির্ধারণ করা হলেও জাল জন্মসনদ ও কোর্টের ভুয়া হলফনামার মাধ্যমে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে থাকে।
এদিকে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং জিআইজেডের রুল অ্যা ল’র এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে গত দুই বছরে বাল্যবিয়ের ৫০ শতাংশের পেছনেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল করোনার। এছাড়া করোনা মহামারির আগে ৩৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী গড়ে ৩-৫ ঘণ্টা পড়াশোনা করলেও মহামারির সময়ে এই হার ১৪ শতাংশে নেমে গেছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে এই গবেষণার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত হওয়া এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল করোনার সংকটে কিশোর-কিশোরীদের জীবনে কীভাবে পরিবর্তন এনেছে তা বিশ্লেষণ করা।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিয়ের হার সর্বোচ্চ। প্রতিবছর প্রায় এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি ১৮ বছরের কম বয়সী কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ২৩টি কন্যাশিশুর, আর প্রতি দুই সেকেন্ডে একজনের।
গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রায় ৫০ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর বাবা-মা জানান, মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে করোনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। মেয়েদের ও তাদের পরিবারের সম্মানকে সুরক্ষিত রাখতে দ্রুত বিয়ে দিতে হবে করোনার সময় প্রতিনিয়ত এমন সামাজিক চাপের মুখে ছিল কিছু পরিবার। ফলে সেসব পরিবারের বাবা-মা তাদের মেয়েদের বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহ এবং স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পেছনে দারিদ্র্যের চেয়ে নিরাপত্তা এবং পারিবারিক সম্মান হারানোর ঝুঁকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল বন্ধ থাকায় ছেলেদের কাজে পাঠান অভিভাবকরা। ওই সময়ে ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরীর ৩৫ শতাংশ জানিয়েছে, করোনার কারণে তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে ১৬ শতাংশ ঝরে পড়া জানিয়েছে, তারা পড়াশোনার খরচই আর চালাতে পারছিল না।
গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনার মহামারিকালীন সংকটে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এসেছে। করোনার কারণে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনো-সামাজিক টানাপড়েন, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এমন বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘আমাদের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং একই সঙ্গে মানুষের সক্ষমতা ও সুস্থতাকে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।’
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘করোনার সময়ে কিশোর-কিশোরীদের ব্যাপারে খুব একটা গবেষণা এবং নীতিনির্ধারণী আলোচনা হয়নি। অর্থনৈতিক কারণ ও স্কুল বন্ধ থাকা এই দুইয়ে মিলে তাদের জন্য আগে থেকেই চলমান ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে এবং নতুন ঝুঁকির ক্ষেত্র তৈরি করেছে।’
বাল্যবিবাহ কিশোরী মেয়েদের সহজাত উচ্ছ্বাস, বৃদ্ধি ও গতিশীলতাকে থামিয়ে দেয়। প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকার কারণে পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব থাকে। এর ফলে অধিক সন্তান গ্রহণের প্রবণতা তৈরি হয়। কৈশোরকালে গর্ভধারণের ফলে মেয়েরা অপুষ্টিতে ভোগে এবং গর্ভকালে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়। অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান প্রসবের কারণে মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
এ কারণে বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পাশাপাশি বাল্যবিবাহবিরোধী পদক্ষেপের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাল্যবিবাহকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশ বাল্যবিয়ে রোধে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও নীতিনির্ধারকরা হঠাৎ করে আসা মহামারির কবলে পড়ে অজান্তেই বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তারা মনে করেন, মহামারিতে বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া মেয়েরা যাতে স্কুলে ফিরে আসতে পারে, তার জন্য এখন সরকারের সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৩
আপনার মতামত জানানঃ