
আজকের ভারতে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল দেশটিতে সব নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় মেরুকরণের আবহে। যদিও এই মেরুকরণের রাজনীতি ভারতে নতুন নয়। আর উত্তরপ্রদেশ যে এই সাম্প্রদায়িকতার লীলাভূমি, তা প্রায় সবারই জানা। ভারতের এই রাজ্যটি জনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বড়; একইসাথে বিতর্কিতও। কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের শাসনে উত্তরপ্রদেশে মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা এখন এতটাই ডালভাত হয়ে গেছে যে মিডিয়াতেও এসব খবর ঠাঁই পায় না।
ভারতে ক্রমশ বিদ্বেষমূলক রাজনীতি দেখা যাচ্ছে। আর তাতে উৎসাহিত হয়ে এক ধরনের মুসিলিম বিদ্বেষী গান লিখছেন শিল্পীরা। এই গান এখন হিন্দুত্ববাদী মিছিলগুলোর অংশ হয়ে গেছে। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির সমাবেশে মুসলিম বিরোধী গানগুলি বাজানো হয়। খবর আলজাজিরা
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি গানের কথা হচ্ছে, ‘ইনসান নাহি হো সালো, হো তুম কসাই; বহুত হো চুকা হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’। এই গানের অর্থ হচ্ছে, তোমরা মানুষ নও, তোমরা কসাই; অনেক হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্ব হয়েছে। এগুলি হল ভজন বা ধর্মীয় গানের লাইন যা গেয়েছেন গায়ক প্রেম কৃষ্ণবংশী। তিন বছর আগে প্রেম কৃষ্ণবংশী গানটি ইউটিউবে পোস্ট করেছিলেন এবং তারপর থেকে সেট হাজার হাজার বার দেখা হয়েছে।
মূলত ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো যা হিন্দি বেল্ট নামে পরিচিত, সেখানেই এই সংস্কৃতি বেশি দেখা যায়। খুঁজে দেখা গেছে, ইউটিউবসহ অন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় এরকম ডজন ডজন মিউজিক ভিডিও রয়েছে। যেসব হিন্দু ডানপন্থীরা এসব গান পছন্দ করেন এবং শেয়ার করেন।
মুসলিম বিদ্বেষমূলক গান গাওয়া এই প্রেম কৃষ্ণবংশী একজন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট। ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌর বাসিন্দা। তিনি চেয়েছিলেন বলিউডের গায়ক হতে। কিন্তু সেখানে অনেক প্রতিযোগিতা। বলিউডের গায়ক হতে না পারলেও তিনি এখন মুসলিম বিদ্বেষমূলক ভজন গান গাইছেন।
ধর্মীয় ভক্তিমূলক গানগুলোকে সাধারণত বলা হয় ভজন। এটি হিন্দুয়ানি ঘরানার গানেরই একটি ধারা। তবে ভারতে এখন ভজন গানের ধারাই বদলে গেছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ভজনে মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করা হচ্ছে। বিশেষত ভারতে বিদ্বেষমূলক রাজনীতির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় এমনটি ঘটছে।
এখন দেখা যাচ্ছে সংগীত, কবিতা ও সিনেমার মতো সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোও হয়ে উঠছে ঘৃণার রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার।
এ ধরনের বিদ্বেষমূলক অনেক ভিডিও এখন ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দেখা যায়। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাই এসব ভিডিওগুলো বেশি শেয়ার করে থাকে।
অনেক ভিডিওতে রীতিমতো সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর গণহত্যার আহ্বান জানানো হয়। গানগুলোতে বলা হয়, ধর্মের নামে তারা ভারতকে মুসলিম রাষ্ট্র বানাচ্ছে। এসব গানগুলোতে ভারতের মোগল সম্রাটদের হানাদার হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
২০১৪ সালে যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আসে, তখন থেকেই ভারতের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিমদের লক্ষ্য করে বিদ্বেষমূলক হামলার ঘটনা বেড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে এখন দেখা যাচ্ছে সংগীত, কবিতা ও সিনেমার মতো সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোও হয়ে উঠছে ঘৃণার রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার।
কৃষ্ণবংশী হিন্দি ও ভোজপুরি ভাষায় গান গেয়ে থাকেন। তিনি থাকেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তর প্রদেশে। তার গানের ভক্তরা সাধারণত এই রাজ্যেরই বাসিন্দা।
তার অনেক গানেই ভারতীয় মুসলমানদের দেশবিরোধী হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং মুসলিমদের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি তার গানে বলেছেন, মুসলিমরা শেষ পর্যন্ত হিন্দুদের নামাজ পড়তে বাধ্য করবে। যদি তারা (হিন্দুরা) জেগে না ওঠে।
যদিও কৃষ্ণবংশীর দাবি, এসব গানের মধ্যে ঘৃণার কোনো উপাদান নেই। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, আমি মনে করি না আমার সঙ্গীত ইসলামফোবিক। আমার সঙ্গীত সত্যকে নির্দেশ করে। কিন্তু তারপরেও কেউ যদি মনে করে যে এসব গানের মাধ্যমে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে তাহলে আমার কিছু করার নেই।
সম্প্রতি, উত্তরপ্রদেশ সরকার মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের প্রশংসা করে গান লেখার জন্য কৃষ্ণবংশীকে পুরস্কৃত করেছে। তিনি যেসব গান লিখেছেন তার অনেকগুলোতেই মোদি এবং আদিত্যনাথের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদদের গুণগান গাওয়া হয়েছে।
এছাড়া গানগুলি মুঘল এবং উপমহাদেশের অন্যান্য মুসলিম শাসকদের সম্পর্কেও নেতিবাচক কথা বলে। এতে মুসলিম শাসকদের আগ্রাসনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন কৃষ্ণবংশী। দাবি করেন, অস্ত্রের মুখে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করা হয়েছে।
একসময় ভজন গানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা বলা হতো। তবে কিছু কিছু বিদ্বেষমূলক গান আগে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করলেও আশঙ্কার বিষয় এই যে, বর্তমানে এগুলো এখন গণসংস্কৃতির অংশ হয়ে যাচ্ছে, যা ভারতে ধর্মীয় সহনশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, উত্তরপ্রদেশে যা ঘটছে সেটাও করা হচ্ছে নির্বাচনকে মাথায় রেখেই। যতই অবিশ্বাস্য শোনাক নির্বাচনের আগে বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বাস্তবতা কিন্তু এটাই। বয়স বারো হোক বা বাহাত্তর, মুসলিমদের পরিকল্পিতভাবে মারধর করা হচ্ছে, জোর করে বলানো হচ্ছে জয় শ্রীরাম। গোটা ঘটনার ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে, যেগুলো দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ছে জাঠদের মহাপঞ্চায়েত।
তারা বলেন, এ রাজ্যে মুসলিমদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আর পুরোটাই করা হচ্ছে পরিকল্পিত ছকে। গবেষণা বলে, যে কোনও দাঙ্গার পরেই মুসলিমরা কিন্তু মিশ্র বসতির এলাকা ছেড়ে গিয়ে নিজেদের ঘেটোতে (ঘেটো হল এমন এলাকা যেখানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যরা বাস করেন; বিশেষত সামাজিক, আইনী বা অর্থনৈতিক চাপের ফলে। ঘেটোগুলো প্রায়শই শহরের অন্যান্য অঞ্চলগুলির চেয়ে বেশি দরিদ্র বলে পরিচিত।) গিয়ে বাস করতে চায়। এখানেও ভোটের আগে ভয় দেখিয়ে ঠিক সেভাবেই মুসলিমদের কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৪
আপনার মতামত জানানঃ