সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল বা তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীর নামই বেশি আসে খবরে৷ তবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্য ‘বড় দলগুলোর’, এমনকি তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন বা বিভিন্ন পেশাজীবীদের রোষানলেও পড়তে হয় সাংবাদিকদের৷
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সাংবাদিক প্রকাশ্যে দিবালোকে লাঞ্ছিতের পর প্রাইভেটকারে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার এজাহারে ৫-৭ জন অজ্ঞাত আসামির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
রোববার (২৯ মে) বিকেল সাড়ে ৩টায় নগরীর শীতলাখোলা এলাকার মুমীতু কমিউনিটি সেন্টারের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকের নাম অপুর্ব অপু। ভুক্তভোগী অপূর্ব অপু বলেন, ‘উজিরপুরে সড়ক দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহ করে বাসায় এসেছিলাম দুপুরের খাবার খেতে। খাবার খেয়ে হেঁটে নগরীর কালিবাড়ি রোডে সময় টিভির অফিসে যাওয়ার সময় মুমীতু কমিউনিটি সেন্টার থেকে এক ব্যক্তি রিকশায় এসে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে। নিউজ কেন করি, এই সব নিয়ে গালাগাল করতে থাকে। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি আমার দিকে ইট ও কাদা ছুড়ে মারে। পরে আমি দৌড় দিয়ে মুমীতু কমিউনিটি সেন্টারের সামনে এলে আরও এক ব্যক্তি আমাকে সাদা একটি প্রাইভেটকারে (বরিশাল মেট্রো গ ১১২১৫৫) ওঠানোর চেষ্টা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেখান থেকে আবার দৌড় দিয়ে আমি পালিয়ে চলে আসি। এরপর সহকর্মী ও পুলিশকে ফোন দেই। আমার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। কী কারণে বা কেন এ হামলা করেছে সেটা বলতে পারছি না।’
সাংবাদিক ইউনিয়ন বরিশালের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরন বলেন, খবর পেয়ে সহকর্মীরাসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। মুমীতু কমিউনিটি সেন্টারের সিসিটিভি ফুটেজে অপুকে মারধর ও অপহরণের চেষ্টার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
সিসি টিভির ফুটেজে আরও দেখা যায়— দুর্বৃত্তরা আগেই সাদা রঙয়ের প্রাইভেটকারটি নিয়ে মুমীতু কমিউনিটি সেন্টারের সামনে আসে এবং বারবার কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে ও বাইরে আসা যাওয়া করে। তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে তাদের পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এদিকে মুমীতু কমিউনিটি সেন্টারের প্রোপাইটার শাহিন হোসেন মল্লিক মামুনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তার দেওয়া তথ্যে ঘটনার সময় সেখানে থাকা কয়েকজন ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আমার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। কী কারণে বা কেন এ হামলা করেছে সেটা বলতে পারছি না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এ ঘটনার সঙ্গে সাবেক ছাত্রদল নেতা জেহাদ, মামুন, আলমসহ আরেকজন জড়িত।
অপরদিকে সাংবাদিক অপুর্ব অপুর সঙ্গে ঘটা ওই ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, বরিশাল প্রেসক্লাব, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি (বিআরইউ), সাংবাদিক ইউনিয়ন বরিশাল, বরিশাল ইলেকট্রনিক মিডিয়া জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিইমজা), বরিশাল টেলিভিশন ক্যামেরা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিটিসিএ) সাংবাদিক সংগঠনগুলো।
সাংবাদিককে ছাত্রলীগ নেতার মারধর
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের টিভি কক্ষে ‘ধূমপান করতে নিষেধ করায়’ এক সাংবাদিককে মারধরের অভিযোগ উঠেছে হল শাখা ছাত্রলীগের এক নেতার বিরুদ্ধে। গতকাল রোববার রাত পৌনে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ হলের টিভি কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। মারধরের শিকার সাংবাদিকের নাম শাহাবুদ্দীন আহমেদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ও অনলাইন পোর্টাল বিডিমর্নিংয়ের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।
শাহাবুদ্দীন মারধরের অভিযোগ তুলেছেন মাদার বখশ হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী গিয়াসউদ্দিন কাজলের বিরুদ্ধে। গিয়াসউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
ঘটনার সময় টিভি কক্ষে উপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল রাতে টিভি কক্ষে আইপিএলের ম্যাচ দেখার সময় কাজল ধূমপান করছিলেন। তখন শাহাবুদ্দীন তাকে বাইরে ধূমপান করতে বলেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতা গিয়াসউদ্দিন তার দুই বন্ধুকে নিয়ে শাহাবুদ্দীনকে মারধর করেন। এতে শাহাবুদ্দীন কানে আঘাত পান ও তার পোশাক ছিঁড়ে যায়। পরে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
জানা যায়, সাংবাদিককে মারধরে অংশ নেওয়া গিয়াসউদ্দিনের দুই সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তবে তারা ওই হলের আবাসিক ছাত্র নন।
এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস না পাওয়ায় গতকাল দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে শাহাবুদ্দীনের সহপাঠীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়া ও মো. সুলতান-উল-ইসলাম, প্রাধ্যক্ষ শামীম হোসেন, প্রক্টর আসাবুল হক সেখানে আসেন। তাঁরা আজ সোমবার আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশ্বাস দেন। পরে বিক্ষোভকারীরা আজ বিকেল পাঁচটার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ স্থগিত করেন।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কতজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার কোনো হিসেব নেই৷ বিভিন্ন মেয়াদের বিচ্ছিন্ন কিছু হিসাব পাওয়া যায়৷ ২০০১ সাল থেকে ২০১৬- এই ১৬ বছরে দেশে ২৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন৷ বিএনপির ২০০১-২০০৬ শাসনামলে নিহত হন ১৪ জন সাংবাদিক, আর আহত হন ৫৬১ জন৷ আর ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে নয় বছরে খুন হন নয় জন সাংবাদিক৷
আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে বাংলাদেশে ৩৮ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডের এই খতিয়ান পূর্ণাঙ্গ নয়৷ অনেক ঘটনাই রয়ে গেছে আড়ালে৷
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন যেন নিত্যদিনের ঘটনা৷ শুধু হামলা নয়, প্রচুর মামলারও শিকার হন সাংবাদিকরা৷ ২০২১ সালে শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কমপক্ষে ১ হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে৷ এই মামলাগুলোর বড় একটা অংশ হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, করোনাকালে এবং এর আগে-পরে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দল ও বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রোষানলে পড়ে হামলা, মামলাসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২১০ জন সাংবাদিক৷ এর মধ্যে নোয়াখালিতে বোরহান উদ্দিন মোজাক্কির নামে একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে-ই সুযোগ পাচ্ছে সে-ই সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন করছে৷ সেটা যে শুধু সরকারি দলের লোক তা নয়, ব্যবসায়ীরা করছে, অর্থশালীরা করছে৷ আসলে সাংবাদিকদের খবরটি যাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তারাই এটা করছে৷
তারা মনে করেন নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তি হলে বারবার নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো না৷ তারা বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী৷ বিচারের জন্য বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে৷ এই যে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ১২ বছরে পুলিশ ৮৮ বার আদালত থেকে সময় নিয়েছে, অথচ খুনিদের ধরতে পারেনি৷ বিচারহীনতার এই সংস্কৃতিটাই সাংবাদিকতা পেশাকে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে৷
তারা আরও বলেন, যাদের বিরুদ্ধে খবর হচ্ছে, তারাই হামলা করছে৷ যারা অন্যায় করে, দখল করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তারাই হামলাকারী৷ আবার নির্দিষ্ট কোনো পেশার সবাই কিন্তু এটা করেন না৷ এই খারাপ মানুষগুলোই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কথা বলেন৷ আমাদের এখন থেকে শক্তভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৩
আপনার মতামত জানানঃ