রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, আরএসএফ সম্প্রতি ২০২১ সালের ‘প্রেস ফ্রিডম প্রিডেটর্স’ বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শিকারিদের তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে বিশ্বের ৩৭ জন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের নাম রয়েছে যারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কঠোর হস্তক্ষেপ করেছেন। তালিকায় দুই নারী নেত্রীর নাম রয়েছে৷ এদের একজন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরিস্থিতি বিবেচনা করলে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ হিসেবে তকমা দেয়া হয়। গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে। সেই সমালোচনা যে পক্ষ থেকেই আসুক না কেন, তা দমন করা হচ্ছে কঠিন হাতে। হোক সে বিরোধীপক্ষ বা শিক্ষার্থী, সাংবাদিক বা সাধারণ নাগরিক। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বাংলাদেশে বিরোধীরা ততোই দমন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সংকুচিত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও।
আর এই পরিস্থিতিতে ঘি ঢেলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার , ষড়যন্ত্র করে ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের (বিএনপিকে) দাঁতভাঙা জবাব দেয়া হবে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন। গতকাল রোববার পাবনার ভেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ভার্চুযালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এসএম কামাল হোসেন বলেন, ১৯৭৫ এর খুনিরা আবার গর্জে উঠবে সেই স্লোগান যদি বিএনপির মধ্যে দেয়, আর সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হলে তার জন্য তো ধন্যবাদ পাওয়া দেয়া উচিত। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আমাদের জায়গায় বিএনপি থাকলে কী করতেন?
তিনি বলেন, বিএনপি যদি এই ধরনের বক্তব্য আবার কোনো সমাবেশে রাখে তাহলে জনগনই তাদের সমাবেশ বন্ধ করে দিবে। যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে, ষড়যন্ত্র করে ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেয় – জনগণকে সাথে নিয়ে তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেয়া হবে।
তত্তাবধায়ক সরকার বিএনপি করেনি উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, তত্তাবধায়ক সরকারের দাবিমুখে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনৈতিদক দলগুলো আন্দোলন করেছেন তখন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলো-শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ লোক না। তারপরে খালেদা জিয়া নির্বাচন করেন। সেই নির্বাচনে জনগন ভোট কেন্দ্রে যায়নি। তারপরও দেখলাম ঢাকায় দুই এমপি ১ লক্ষ করে ভোট পেয়েছিল। তখন খালেদা জিয়া শপথ নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু জনগণ বলেছিল এই নির্বাচন মানি না।
তিনি বলেন, আজকে ’৭৫ এর খুনি এবং ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার প্রধান আসামি তারেক জিয়ার প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, অপপ্রচার করছে।
তবে মনে রাখা উচিত কেউ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নয়। আসলে স্বাধীনতার ‘স্বপক্ষে’ বা ‘বিপক্ষের’ শক্তি আখ্যা দিয়ে সব মানুষকে বিচার করা যেমন যায় না, তেমনি ‘আওয়ামী লীগ’ বা ‘বিএনপি-জামায়াত’ দিয়েও সবাইকে বিবেচনা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের অনেক মানুষ কোন রাজনৈতিক পরিচয় বহন করেন না। তারা যে কোনো ইস্যুতে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। আর সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেই কেউ ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ বা ‘বিরোধী দলের প্রতিনিধি’ হয়ে যান না। বরং সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত করার চেয়ে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়াই সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে আমাদের।
তবে সমালোচনার বিরুদ্ধে সবসময়ই কঠোর অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে যখন করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়, তখন থেকেই গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করে র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদ। যেখানে পুলিশি নির্যাতনে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে।
এ ক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারের যে অব্যবস্থাপনা রয়েছে সেগুলো নিয়ে কেউ যাতে কথা বলতে না পারে সেজন্য সবার মনে ভয় ধরিয়ে দিতে চায় সরকার। এজন্যই ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করা হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন মনে করেন সরকারের সহিষ্ণুতার অভাব থেকেই এ ধরণের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
এদিকে, রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা হয়েছে অনেক। বিরোধীদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন সাধারণ মানুষ যেমন আছেন, তেমনি আছেন পরিবেশবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট, এমনকি বামদলের সমর্থকসহ অনেকে। আবার রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে সোচ্চারদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাসীন দলের সক্রিয় সমর্থকসহ রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন মানুষও।
ক্ষমতাসীনদলের সমর্থকরা রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতাকারীদের ফেলছেন ‘ভারত বিরোধীদের’ তালিকায়। তাদের যুক্তি হচ্ছে ভারতের বিরোধীতা করা উদ্দেশ্যে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করছে অনেকে। অথচ যারা বিরোধিতা করছেন, তারা সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন কারণ দেখাচ্ছেন , সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করছেন, যেগুলোর সঠিক উত্তর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়নি।
উল্টো সরকারের সমর্থকরা নানাভাবে বিরোধিতাকারীদের দেশের উন্নয়নবিরোধী আখ্যা দিয়ে ‘জঙ্গিবাদ ইস্যু’ থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করা হচ্ছে বলে দাবি করেন।
২০২০ সালে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে “অবমাননাকর” পোস্ট করায় ১৫ বছরের এক শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকার উত্তরে ভালুকায় পুলিশ গনমাধ্যমকে জানায় তারা শিশুটিকে গ্রেপ্তার করেছিল যখন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ করে ছেলেটি “আমাদের মায়ের মত নেত্রীকে … অপবাদ” দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনা করায় কাউকে গ্রেপ্তার করা শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন নয়, সর্বশেষ উপায় ছাড়া ১৮ বছরের নিচে কোন শিশুকে আটক করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেরও লঙ্ঘন। তবুও গ্রেফতার করা হয় ওই কিশোরকে।
প্রসঙ্গত, ওই একই বছর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের বৈশ্বিক রিপোর্ট ২০২০-এ বলা হয়, জালিয়াতির অভিযোগ ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নির্যাতনের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে জয় লাভ করে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধী মতের কন্ঠরোধ করে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্যাতনের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়।
এরপর ধীরে ধীরে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে আরও কঠোর থেকে কঠোর অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। চলতি বছর জানুয়ারিতেই আওয়ামী লীগের ‘আওয়ামী’ শব্দের অর্থ বিকৃত করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে এক তরুণকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় রাজশাহীর একটি আদালত।
একজন আওয়ামী লীগ নেতার করা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার এই মামলার রায়ে একই সঙ্গে ওই যুবককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই গুরুদণ্ড এবং রাজনৈতিক বিতর্কসহ সবকিছু আদালতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সিনিয়র আইনজীবীরা।
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ব্যক্তির মানহানি হলে আইন অনুযায়ী মানহানি মামলা হয় কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো প্রতিষ্ঠান। এ মামলায় আওয়ামী লীগের মানহানি হলে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে পারতো৷ কিন্তু তা হয়নি।
তিনি বলেন কিছু বিষয় আছে যেগুলো রাজনীতি ও সংবিধানের সাথে জড়িত৷ সেগুলো অনেক সময় আদালতে আসে জাতীয় স্বার্থে। কিন্তু ব্যক্তিগত বা দলীয় প্রচার-পাল্টা প্রচার, কুৎসা-পাল্টা কুৎসা এগুলো তো আদালতে বয়ে আনার যুক্তি নেই৷ এসব বিষয়ে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স যারা করবেন তাদের শক্তভাবে এগুলো দেখা উচিত।
দণ্ডপ্রাপ্ত তরুণের নাম আবদুল মুকিত ওরফে রাজু (২২)। তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর গ্রামের রিয়াজুল ইসলামের ছেলে। ২০১৭ সালে মামলাটি করেছিলেন হরিপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইদুর রহমান বাদল৷ মুকিত হরিপুর ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের সভাপতি বলে দাবি সাইদুর রহমানের।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ২৭ মে আবদুল মুকিত তার ফেসবুক আইডিতে আওয়ামী লীগকে ব্যঙ্গ করে বাবা ও ছেলের কথোপকথনের ঢঙে একটি কৌতুক পোস্ট করেন৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, আওয়ামী শব্দটি আইয়াম শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ অন্ধকার, কুসংস্কার আর লীগ অর্থ দল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ মানে অন্ধকারের দল৷ সেখানে ইসলাম ও আওয়ামী শব্দটি নিয়ে সাংঘর্ষিক অবস্থানে এনে উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি বাদির।
মূলত, একটি স্বাধীন দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক৷ এই স্বাধীনতা নিয়ে আলাদা কোনো আলোচনাই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ সেই আলোচনা নিয়েই আছে। স্বাধীনতা অর্জন করেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে কখনো বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করতে পারেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ