বাংলাদেশে এখনো আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয় বন্দরের জন্য৷ সতর্ক সংকেতগুলো সাধারণ মানুষ বোঝেন না৷ দেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যায় আগাম কোনো পূর্বাভাস দিয়ে কৃষকদের ফসল রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া যায়নি৷
উপকূলীয় বাঁধগুলো ভাদ্রমাসের জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়৷ উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে উজাড় হয়ে যাচ্ছে৷ বজ্রপাত প্রতিরোধে লাগানো তালগাছ কেতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই৷ উপকূলের ৩২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দুই লাখ ৫৬ হাজার মানুষ এবং প্রায় ৪৪ হাজার গবাদি প্রাণীর আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ আছে৷ কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয় নিতে চায় না৷
এই পরিস্থিতির সাথে মিলে গেছে বিশ্ব ঝুঁকি সূচক ২০২১। জার্মানির নয়টি উন্নয়ন ও ত্রাণ সংস্থার অ্যালায়েন্স ‘ব্যুন্ডনিস এন্টভিকলুং হিল্ফট’ ১৮১টি দেশের তথ্য নিয়ে গতবছর ‘বিশ্ব ঝুঁকি সূচক ২০২১’ প্রকাশ করে৷ জার্মানির রুয়র-ইউনিভার্সিটি বোখুমের ‘ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ল অফ পিস অ্যাণ্ড আর্মড কনফ্লিক্ট’ এতে সহায়তা করেছে৷
এছাড়া জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যাণ্ড হিউম্যান সিকিউরিটি’ এই সূচক নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে৷
ব্যুন্ডনিস এন্টভিকলুং হিল্ফট মনে করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানো না গেলেও দারিদ্র্য ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত শক্তিশালীকরণ এবং দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো যায়৷ যেসব দেশ ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ভবন তৈরি করে, আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং জলবায়ু ও পরিবেশ নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করে তারা দুর্যোগ মোকাবেলায় ভালোভাবে প্রস্তুত বলে ধরে নেয়া হয়৷
এই তালিকায় মোট ৩৬টি দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বলে সূচকে উল্লেখ করা হয়েছে৷ বাংলাদেশ আছে ১৩ নম্বরে৷
যেখানে পিছিয়ে বাংলাদেশ
সাগরের পানি বৃদ্ধি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ও খরা; এই পাঁচ প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকির মাত্রা কোন দেশে কতখানি, তা নিয়ে একটি সূচক প্রকাশ করা হয়েছে৷
এতে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ৷ ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন্স, নেদারল্যান্ডস, গ্রিস ও ছোট কিছু দ্বীপরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশ এই তালিকায় আছে৷
দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি কেমন তার চিত্র ঝুঁকি সূচকে পাওয়া যায়৷ এতে দেখা যাচ্ছে, দুর্যোগের তাৎক্ষণিক প্রভাব কমাতে সবচেয়ে কম সক্ষম দেশের একটি বাংলাদেশ৷
দুর্নীতির ধারণা সূচক, ব্যর্থ রাষ্ট্র সূচক, দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, ডাক্তার ও হাসপাতালের বিছানার সংখ্যা, বিমা ইত্যাদি তথ্যের ভিত্তিতে ‘ল্যাক অফ কোপিং ক্যাপাসিটিস’ সূচকটি করা হয়েছে৷
দুর্যোগ মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণেও সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ৷ বয়স্ক শিক্ষার হার, শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বন ও কৃষি ব্যবস্থাপনা, সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ায় খরচ ইত্যাদি বিবেচনায় ‘ল্যাক অফ অ্যাডাপ্টিভ ক্যাপাসিটিস’ সূচকটি তৈরি করা হয়েছে৷
বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশংসনীয় সফল্য অর্জন করলেও আরো অনেক দূর যেতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম৷ চলতি দশকে বাংলাদেশের ১১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছেন৷
বাংলাদেশে কৃষক ও কৃষিকে সামনে রেখে কোনো আবহাওয়ার পূর্বভাস দেয়া হয় না৷ কখন বৃষ্টি হবে, কখন পানি বাড়বে এগুলো কৃষক জানেন না৷ ফলে তার ফসল ডুবে যায়, বাড়ি ডুবে যায়, ঢলে সব শেষ হয়ে যায়৷
এদিকে, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ আছে৷ কিন্তু এবারের হাওরের বন্যায় বাঁধ টেকেনি৷ আর ভাদ্র মাসের পানির চাপ নিতে পারে না অধিকাংশ বাঁধ৷ প্রতি বছরই বাঁধ নির্মাণের পিছনে শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়৷
গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স বলছে, বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ১৮৫টি আবহাওয়াজনিত তীব্র দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে৷ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের৷ আর শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ বিপদাপন্নতায় পৃথিবীতে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে রয়েছে৷
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ হিসেবে সামনে এসেছে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু৷ এছাড়া ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যেও রয়েছে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশে বছরে এখন প্রায় তিনশ’ মানুষ বজ্রপাতে মারা যান৷ আর এই বজ্রপাত ঠেকাতে সারা দেশে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প নেয়া হয়েছিল৷ এখন ৩৮ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্প বাতিল করে এখন বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে৷
বিশেষজ্ঞদের মতামত
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, ‘‘আসলে তালগাছ বিষয় নয়, আমাদের দরকার উঁচু গাছ৷ আমরা নিজেরাই গাছ কেটে ফেলেছি৷ নিজেরাই নিজেদের বিপর্যয় ডেকে এনেছি৷ আর তাল গাছ তো সব জায়গায় লাগানো যাবে না৷ শহরে তালগাছ লাগাবেন কিভাবে?’’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ এখন ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা৷ সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভবন ধ্বসে পড়বে৷ কারণ, বিল্ডিং কোডে এখন ভূমিকম্প সহনীয় শর্ত রাখা হলেও এর আগে তো অধিকাংশ ভবন তৈরি হয়েছে৷’’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘‘একটি আশ্রয় কেন্দ্রে একজন মানুষের জন্য দুই বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ৷ সেই জায়গায় একজন মানুষ কতক্ষণ থাকতে পারে৷ এখন তো ৫৬ ঘন্টা আগে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলা হয়৷ নারী আছে, শিশু আছে তারা কি অতটুকু জায়গায় থাকতে পারে? ফলে তারা যায় না৷ এর ফলাফল অনেকের মৃত্যু হয় ঘূর্ণিঝড়ে৷’’
তিনি বলেন, একটি আশ্রয় কেন্দ্রের অর্থ দিয়ে ৪০টি দোতলা বাড়ি করা সম্ভব নীচতলা ফাঁকা রেখে ৷ কিন্তু সেটা করা হয়নি৷ তাই অবকাঠামো থাকলেও দুযোর্গে কাজে লাগে না৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ