২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই তিনটি নির্বাচনের মধ্যে কেবল ২০০৮ সালের নির্বাচনটিই ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন কেন দেশে-বিদেশে এতবেশি সমালোচিত? এর সম্ভাব্য উত্তর, নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। সংবিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অধীনে ফের নির্বাচন হবে। তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো এবারের নির্বাচনও কী বিতর্কিত হতে চলেছে? বিতর্কমুক্ত থাকতে বছরের শুরুতে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন পাস করে ক্ষমতাসীন সরকার। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এটি একটি অলৌকিক ঘটনা।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হিসাব দেখলে দেখা যাবে, মোট ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৭ টিতে জিততে দেয়া হয়েছিল বিরোধী দলকে। এদিকে, আগামী ২০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর এই নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এই নির্বাচনকে কতখানি সুষ্ঠু ও স্বাধীন হতে দেবে এবং এতে জনগণের ইচ্ছা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে কিনা।
গত ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে; ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে। ২০০৬ ও ২০০৭ এই দুই বছর সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার পর ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আর সেই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবং ২০০৮ সালের সেই নির্বাচনই সর্বশেষ স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ এরপরের দুইটি নির্বাচন পাতানো বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মাথায়, ২০১১ সালে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে অপসারণ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর প্রতিবাদ স্বরূপ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বে ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট বা বর্জন করে বিরোধীদলগুলো। সেসময় তারা বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কিন্তু তাদের বয়কটের সিদ্ধান্তকে আমলে না নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই নির্বাচনের পর বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দুতাবাস থেকে বক্তব্য দেওয়া হয়, যেখানে বলা হয়, “সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফলে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে হয় না” এবং “বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলগুলোর” উচিত “কিভাবে একটি স্বাধীন, সুষ্ঠু, হানাহানি-হীন, এবং আস্থাযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা যায় তা নিয়ে অতিশীঘ্র আলোচনায় বসা…”।
সেসময় এই বক্তব্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, নির্বাচন নিয়ে প্রায় সব পশ্চিমা রাষ্ট্রের মনোভাবের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু নির্বাচনের পর এর বিরুদ্ধে বড় কোন প্রতিবাদ বা অসন্তোষ দেখা যায়নি, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও নতুন করে নির্বাচন করা নিয়ে চাপ দেয়া বন্ধ করে দেয় দ্রুতই। এদিকে বিএনপির নির্বাচন বয়কট করার কারণটা বোধগম্য হলেও অনেকেই দলটির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। সমালোচকদের দাবি, নির্বাচনী জরিপে বেশ এগিয়ে থাকার পরও নির্বাচনে অংশ না নেয়াটা বিএনপির বোকামি ছিল। কেননা বিএনপি অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনে কারচুপি করা এত সহজ হতো না আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে।
এরই ধারাবাহিকতায় চার বছর পর ২০১৮ সালে যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন তাতে অংশগ্রহণের জন্য বেশ চাপের মুখে পড়ে বিএনপি এবং দলটি সেই নির্বাচনে অংশও নেয়। নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ আওয়ামী লীগের জন্য খুব জরুরি ছিল, কারণ তারা বারবারই বলে এসেছে যে তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এটা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য একটা পরীক্ষা। যাই হোক, হয়ে গেল নির্বাচন। কিন্তু ২০১৪ সালে যা আশঙ্কা করে নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি, ঠিক সেসবই ঘটেছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে। এই নির্বাচন হলো সম্পূর্ণ পাতানো।
২০১৮ সালের নির্বাচনের স্মৃতি এখনও দগদগে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে। আর তাই ২০২৩ এ অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান হলো “বর্তমান সরকারে অধীনে” তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কেমন হবে তা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উপর তেমন একটা নির্ভর করবে না, যদিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কিছুটা প্রভাব থাকবেই। বরং পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা এবং আওয়ামী লীগ সে ভূমিকাকে কতখানি গুরুত্বের সাথে দেখছে তার ওপর নির্ভর করবে এই নির্বাচনের রূপ।
যদি বহির্বিশ্ব থেকে কোন চাপ না আসে তাহলে ধারণা করা যেতে পারে যে এবারও ২০১৮ সালের মতোই কারচুপির নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ। যদিও সেবারের মতো শতভাগ কারচুপি খুব সম্ভবত হবে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের জুলুম-নির্যাতনের ভয়, সেই সাথে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসতে সাধারণ মানুষের অনীহার কারণে এবারও আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে যাবে।
তবে পরিস্থিতি এমন হলেও সম্প্রতি তাতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিভাবে? এই পরিবর্তনের নেপথ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি এ্যাক্ট ২০১৬। এই আইনের বদৌলতে বিশ্বের শক্তিধর দেশটি এখন মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধনের অভিযোগে ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আইনি ক্ষমতা রাখে। মার্কিন এই আইন বলবৎ হয় ২০১৬ সালে, অর্থাৎ বাংলাদেশের ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে, এবং যুক্তরাষ্ট্র আইনটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রথম প্রয়োগ করে ২০১৮ সালে, একই বছর বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কিছু আগে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ২০১৮ সালের ওই নির্বাচনের পর যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও একই ধরনের বিধান প্রণয়ন করে। ইতোমধ্যে এই বিধানগুলো বেশ জোরেশোরেই প্রয়োগ করেছে তারা, যা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনার ক্ষেত্রেই সীমিত থাকেনি, বরং পাতানো বা মেকি নির্বাচনের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয়েছে—উদাহরণ হিসেবে ২০২০ এ বেলারুশের নির্বাচন এবং ২০২১ এর নিকারাগুয়ার নির্বাচনের কথা বলা যায়।
পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বেরই বলা যায়। আর সেজন্যই ২০১৮ সালের পর প্রণিত এই বিধানগুলো বাংলাদেশের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না বলেই খুব সম্ভব ভেবেছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এই ধারণা ভেঙ্গে যায় যায় ২০২১ এর ডিসেম্বরে। এসময় বাংলাদেশের বিশেষ বাহিনী র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা আরও আসে র্যাবের বর্তমান এবং প্রাক্তন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর, যার মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদও।
নিষেধাজ্ঞাগুলো জারি হওয়ায় বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে মত বিনিময় করেছেন বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। আর এই সমস্ত আলোচনা থেকে একটি বিষয় তারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞাগুলো সরিয়ে নেওয়ার কোনও সম্ভাবনা আপাতত নেই।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বক্তব্যেও একথা পুনরায় প্রকাশ পেয়েছে। রাষ্ট্রদূত তার বক্তব্যে আরও বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক এবং সার্বিকভাবে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সুরক্ষার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার ভিত্তিতেই কেবল নিষেধাজ্ঞা অপসারিত হতে পারে।
ডিসেম্বর ২০২১ এর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশকে অন্য কোনও রাষ্ট্রের তরফ থেকে নতুন কোনও নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়নি। জানা যায়, যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশের অন্তত কয়েকজন কর্মকর্তাকে জানিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের কোনও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না। একই সঙ্গে বেশ কয়েকজন কূটনীতিক বিএনপির কয়েকজন নেতাকে জানিয়েছে যে তারা এই নিষেধাজ্ঞার ভয়কে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে গণতন্ত্র উন্নয়নে ও সুষ্ঠু স্বাধীন নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে চান।
অর্থাৎ ভবিষ্যত কোনও নিষেধাজ্ঞার সরাসরি ঝুঁকি না থাকলেও একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আছে বাংলাদেশ সরকার। কেননা এবারও প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত সংস্কার না করেই যদি আরেকটি পাতানো নির্বাচনের আয়োজন করে তারা, সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র তিরষ্কারের মুখে পড়বে কিনা তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশ সরকার কোন একক সত্ত্বা নয়। এর বিভিন্ন ভাগ রয়েছে, যাদের আছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। তবে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দিয়ে থাকেন। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বিভিন্ন ফোরামে হওয়া আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে সরকারের কয়েকজন জেষ্ঠ্য সদস্য অন্তত অনুধাবন করছেন যে ২০১৮ সালের পাতানো নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি আর ঘটানো যাবে না, এবং পরিবর্তন আনতেই হবে। পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। সরকার সবধরনের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করেছে, যদিও এই দুই অপরাধ দেশে ঘটে বলেই তারা স্বীকার করে না। নিষেধাজ্ঞা আসার পর থেকে এসব ঘটনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে এসেছে এবং ধারণা করা যায় যে এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে।
তবে এখানে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও একটা ভূমিকা আছে কিন্তু। পশ্চিমা বিশ্ব কোন পদক্ষেপ নেবে তা নির্ভর করবে পাতানো নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তার ওপর। যদি বড় ধরনের কোনও প্রতিবাদ না ঘটে তবে পশ্চিমা বিশ্ব হয়তো সামান্য প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু যদি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ঘটে, যেমন বেলারুশে হয়েছে, এবং সরকার তা শক্তি দিয়ে দমনের চেষ্ট চালায় তবে আন্তর্জাতিকভাবে বেশ শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ