সম্প্রতি দেশে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব অপরাধ ও অপকর্মের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা ও ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এমনকি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মতো ঘৃণ্য অপরাধও আছে।
জমি নিয়ে মারামারির একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বাদীর মেয়েকে ভয় দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে এক এসআইর বিরুদ্ধে। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের একটি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় আদালতে মামলা হয়েছে। এখন পুলিশের হুমকিতে ভুক্তভোগী ওই নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। শনিবার(২১ মে) ওই ধর্ষিতা গাইবান্ধা প্রেসক্লাবে এসে সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ তুলে ধরে ধর্ষক পুলিশ কর্মকর্তার শাস্তি দাবি করেছেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বর্তমানে রংপুরের মিঠাপুকুর থানায় কর্মরত ।
সংবাদ সম্মেলনে ওই নারী অভিযোগ করেন, তার বিধবা মা ২০২১ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর জমিজমা নিয়ে ফুলছড়ি থানায় ৮ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। পরে ২৪শে অক্টোবর রাতে মামলার তদন্ত করতে আসেন ফুলছড়ি থানার এসআই শামসুল হক। চরাঞ্চলের নিধুয়া পাথারের মধ্যে বাদীর বাড়িতে ঢুকে ঘর থেকে তার মা ও ছোট ভাইকে বের করে দিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে কু-প্রস্তাব দেন। এক পর্যায়ে মিথ্যা মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেন। পরদিন ভুক্তভোগী নারী থানায় গিয়ে ওসিকে ঘটনাটি অবগত করেন। কিন্তু ওসি কাওসার আহম্মেদ তাদের অভিযোগের কোনো সুরাহা না করে থানা থেকে বের করে দেন।
এ ঘটনার পর ১১ই ডিসেম্বর তদন্তের কথা বলে এসআই শামসুল হক ভুক্তভোগী নারীকে বালাসীঘাটে ডাকেন। সেখানে তার খালার বাড়িতে আবারো ধর্ষণ করেন। এতে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে চলতি বছরের ২৫শে জানুয়ারি ওষুধ প্রয়োগে তার আড়াই মাসের বাচ্চা নষ্ট করেন এসআই শামসুল। এতে ওই নারী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।
এ ঘটনার পর গত ৯ই জানুয়ারি গাইবান্ধা পুলিশ সুপার বরাবরে আবেদন করেন। ইতিমধ্যে অভিযুক্ত ধর্ষক এসআই শামসুল হক ফুলছড়ি থানা থেকে বদলি নিয়ে রংপুরের মিঠাপুকুর থানায় যোগ দেন। থানায় কোনো প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগী নারী গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলা করেন। দীর্ঘদিনেও ধর্ষক পুলিশ কর্মকর্তা শামসুল হকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ধর্ষিত নারী গাইবান্ধা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।
সাংবাদিকদের কাছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ধর্ষণের দ্রুত বিচার না পেলে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন।
ভুক্তভোগী নারী থানায় গিয়ে ওসিকে ঘটনাটি অবগত করেন। কিন্তু ওসি কাওসার আহম্মেদ তাদের অভিযোগের কোনো সুরাহা না করে থানা থেকে বের করে দেন।
গত বছরের ২৪ অক্টোবরের সেই ঘটনার বিষয়ে তরুণীর মা বলেন, ‘রাত সাড়ে ১০টার দিকে এসআই শামছুল হক বাড়িতে এসে গেটে টোকা দেয়। গেট খুলে দিলে বলে- আপনে এখানে দাঁড়ান; আপনার মেয়ের সাথে কথা আছে। আমি বলি, কী কথা- আমার সামনে কন। পরে ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে মেয়েকে মারধর এবং ধর্ষণ করে।’ তিনি এ ঘটনায় এসআইর ফাঁসি চান।
তরুণী স্বামীর সঙ্গে রাগ করে এসে মায়ের কাছে থাকছিলেন।
পিবিআইর এসআই জুলফিকার আলী ভুট্টু বলেন, মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। প্রায় তিন মাস পর গত বুধবার আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, টাকার বিনিময়ে ঘটনাটি মীমাংসা করার জন্য চাপ দেয় স্থানীয় কয়েকজন দালাল ও এসআই শামছুলের লোকজন। এভাবে মামলা করার ক্ষেত্রে সময় ক্ষেপণ করা হয়। এ ছাড়া তরুণী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয়টি শামছুল জানতে পারলে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুকৌশলে ওষুধ খাওয়ান। এর পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি তার গর্ভপাত ঘটে। অসুস্থ হয়ে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাও নেন তরুণী।
এ প্রসঙ্গে ফুলছড়ি থানার ওসি কাওছার আলী বলেন, আমার থানায় তরুণীর মা জমি নিয়ে মারামারির ঘটনায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় শামছুল হক তদন্ত করে আসামি ধরে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তদন্তকালে শামছুল বাদীর পরিবারের সঙ্গে কী করেছে, তা জানি না। তিনি দাবি করেন, তরুণী এসআইর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেননি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারির দুর্বলতাতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে শুধু নজরদারি বাড়ানো নয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারলে অনেকাংশে কমানো সম্ভব পুলিশ সদস্যদের অপরাধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ