শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন দেশটির ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে। বৃহস্পতিবার ৬টা ৩০ মিনিটে তিনি শপথ নেবেন। আজ তার দল থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
এর আগে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন বিক্রমাসিংহে। মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে বেশ জল্পনা-কল্পনা চলছিল দেশটিতে।
জানা গেছে, শপথ গ্রহণ করে তিনি কলম্বোর একটি মন্দিরে যাবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তার কার্যক্রম শুরু করবেন। এ নিয়ে পঞ্চম বারের মতো তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখবেন লঙ্কানরা। এর আগে আরও চার বার তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
এর আগে চলতি সপ্তাহে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের কথা জানান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। চলমান সহিংস আন্দোলনের মধ্যেই তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেঙে যায় দেশটির মন্ত্রিসভা।
এক বিবৃতিতে গোতাবায়ে রাজাপাকসে জানান, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও দেশের কার্যক্রম পরিচালনায় নতুন সরকার গঠনে আমি পদক্ষেপ নিচ্ছি। সংসদের হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়ার জন্য কিছু সাংবিধানিক সংস্কার করা হবে বলেও জানান রাষ্ট্রপতি।
গত ২০ বছরের মধ্যে ১২ বছরই শ্রীলঙ্কার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা। এসময় তারা স্বৈরতন্ত্রের তকমা পেয়েছেন। মাহিন্দা রাজাপাকসে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন। তাছাড়া তার অন্য দুই ভাই দেশটির বন্দর ও কৃষি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এভাবে পাকসে পরিবারের কয়েক ডজন সদস্য সরকারের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কে এই রনিল বিক্রমাসিংহে?
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সঙ্কটকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভের মুখে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এরপর থেকে গেল দুই দিন সঙ্কটপূর্ণ দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কে নেবেন তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার জানা গেল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে হচ্ছেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪৯ সালের ২৪ মার্চ জন্ম নেওয়া রনিল বিক্রমাসিংহে বর্তমানে দলের মনোনীত সংসদ সদস্য। রাজনৈতিক পরিবারের জন্ম নেওয়া রনিল সিলন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন। গেল শতাব্দির সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে শ্রীলঙ্কার পুরোনো রাজনৈতিক দল ইউএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো দেশটির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সেবার তিনি সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে যুব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন।
১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা রনিলকে শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে প্রধানমন্ত্রী ডি বি উইজেতুঙ্গা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। আর উইজেতুঙ্গার প্রধানমন্ত্রীর পদে স্থলাভিষিক্ত হন রনিল বিক্রমাসিংহে। ১৯৯৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা চলাকালে গামিনী দিশানায়েক হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীতে ওই বছরের নভেম্বরে রনিলকে বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত করা হয়।
২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা পুনরায় তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে জোট করে সেবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়ে ১০৬ আসনে জয়ী হলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। ৩৫ আসন নিয়ে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি তার সঙ্গে সংসদে যোগ দিলে তিনি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। তার স্থলে তৎকালীন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল মেনে না নেওয়ায় দেশটিতে সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দেয়।
উত্তেজনা, সহিংসতা কমে এলেও বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। মাহিন্দার ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগই শ্রীলঙ্কানদের কাছে একমাত্র সমাধান।
২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিরিসেনা পুনরায় তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলে সেই সঙ্কট দূর হয়। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ২০ নভেম্বর তিনি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রী হন। ২০২০ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তিনি জয়ী হতে পারেননি। পরে দলের মনোনীত এমপি হিসেবে সংসদে যান এবং ২০২১ সালের ২৩ জুনে তিনি শপথ নেন।
১৯৯৪ সালের পর থেকে তিনি ইউএনপির নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
মাহিন্দা রাজাপাকসে ও তার মিত্রদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
শ্রীলঙ্কায় সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও তার মিত্রদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১১ মে) মাহিন্দা, তার রাজনীতিবিদ পুত্র নামাল ও আরও ১৫ মিত্রকে দেশত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন স্থানীয় একটি আদালত। সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংসতার অভিযোগে তাদের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া গত সোমবার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার তদন্ত করতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন কলম্বোর ম্যাজিস্ট্রেট। সেদিনের ওই ঘটনার জেরে দেশটিতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যাতে প্রাণ হারান অন্তত নয়জন, ক্ষয়ক্ষতিও হয় প্রচুর।
লঙ্কান আদালতের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপি’কে জানিয়েছেন, আদালতে একটি আবেদনে রাজাপাকসে ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ, যেভাবেই হোক, যেকোনো সন্দেহভাজনকে আটক করার ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে।
গত সোমবারের সহিংসতায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজাপাকসে ও তার সহযোগীরা প্রায় তিন হাজার সমর্থককে বাসে করে কলম্বোয় নিয়ে গিয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করতে প্ররোচিত করেছিলেন। তাদের দাবি, সরকার সমর্থকরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বেরিয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়।
এ ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২২৫ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং ক্যাথলিক পুরোহিতও ছিলেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। একরাতের মধ্যেই অগ্নিসংযোগ করা হয় শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী-এমপিসহ প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক নেতার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। সহিংসতায় প্রাণ হারান এক এমপি, আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় আরও একজনকে। হামলার শিকার হন সরকারি কর্মকর্তারাও।
পরে তোপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ তখনো যায়নি। তারা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করেন। শেষপর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য নিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে সরকারি বাসভবন ছাড়েন তিনি।
৭৬ বছর বয়সী এ নেতা বর্তমানে শ্রীলঙ্কার পূর্বাঞ্চলীয় একটি নৌঘাঁটিতে লুকিয়ে রয়েছেন। তার ছেলে নামাল গত মঙ্গলবার জানিয়েছেন, মাহিন্দা রাজাপাকসের দেশত্যাগ করার কোনো পরিকল্পনা নেই।
প্রেসিডেন্টের পদত্যাগই সমাধান
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর মাহিন্দা রাজাপাকসের সমর্থকদের হামলার ফলে যে অরাজক পরিস্থিতি ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল; তা প্রশমিত হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা তাদের অহিংস অবস্থানে ফিরে গেছে। আবার হামলা করে আন্দোলনকারীদের বিক্ষুব্ধ না করে তুললে ক্ষমতাসীন দলের এমপি-নেতাদেরও জনতার হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে উত্তেজনা, সহিংসতা কমে এলেও বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। মাহিন্দার ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগই শ্রীলঙ্কানদের কাছে একমাত্র সমাধান।
রাজাপাকসে পরিবার ও তাদের অনুগতরা বলছেন, প্রেসিডেন্টের পদত্যাগে সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে। এটা দেশকে অরাজকতার দিকে নিয়ে যাবে। আইনজীবীরা এর জবাব খুঁজছেন। তারা সংবিধানের মধ্যে থেকে একটি আইনি কাঠামো বা প্রস্তাব দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, যার মাধ্যমে ঠিক হবে গোতাবায়ার পদত্যাগের পর কে শ্রীলঙ্কার হাল ধরবেন। তিনি সংসদের মাধ্যমে কীভাবে নির্বাচিত হবেন- সেই পথও খোঁজা হবে।
শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে স্পিকার দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেওয়ারদেনা রাজাপাকসে ভ্রাতৃদ্বয়ের অনুগত। তাই তিনি আন্দোলনকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য বিকল্প নন। সংবিধানে আরও রয়েছে, সংসদ সদস্যরা একজন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন। যিনি পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।
কিন্তু সংসদে রাজাপাকসের দল শ্রীলঙ্কা পুদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) অথবা বিরোধীদের একক সংগরিষ্ঠতা নেই। এসএলপিপি ছেড়ে ৪০ জন এমপি চলে গেছেন। ফলে স্পষ্ট নয়- কার পক্ষে নতুন সরকার গঠন সম্ভব।
শ্রীলঙ্কা যদিও প্রেসিডেন্ট শাসিত দেশ; কিন্তু তার পক্ষে মন্ত্রিসভা ছাড়া দেশ শাসন সম্ভব নয়। গত সোমবার মাহিন্দার পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভাও বিলুপ্ত হয়েছে। গোটাবায়া শিগগির সংসদের অনুমোদনে একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবেন- তেমন সম্ভাবনা নেই। ফলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হলেও অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ