শান্তিপূর্ণ পর্যায় থেকে ক্রমশ সহিংস রূপ নিচ্ছে শ্রীলঙ্কার সরকার পতন আন্দোলন। সোমবার দেশটির সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের ব্যক্তিগত বাসভবনসহ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। চলমান এই সহিংসতায় দেশটিতে হতাহতের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ২০০ জনে।
মূলত সোমবার (৯ মে) শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর সহিংসতা শুরু হয়। মঙ্গলবার (১০ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, সোমবার থেকে চলা এই সহিংসতায় এখন পর্যন্ত পাঁচ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন ১৯০ জনেরও বেশি মানুষ। এই পরিস্থিতিতে দেশটিতে চলমান কারফিউ বুধবার সকাল পর্যন্ত বাড়িয়েছে শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষ।
এদিকে শ্রীলঙ্কার সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের ভাই ও দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে এখনও বহু মানুষ বিক্ষোভ করছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান দাম এবং বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে।
সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে বলছে, শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীরা দেশটির শাসকদলের তিনজন সাবেক মন্ত্রী ও দুইজন এমপির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এছাড়া রাজাপাকসে পরিবারের পৈত্রিক বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্টের অফিস ঘিরে বিক্ষোভ চলছে।
এছাড়া সোমবার কলম্বোয় বিক্ষোভকারীরা পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বাড়ি ঘেরাও করে দু’টি গেট ভেঙে দেয়। তারপরই সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনেই একটি বাসও পুড়িয়েছে বিক্ষোভকারীরা।
পরে সরকার সমর্থকরা রাজধানী কলম্বোতে মাহিন্দা রাজাপাকসের টেম্পল ট্রির বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভকারীদের সাথে সহিংস সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পরে সেই সংঘর্ষ ছড়ায় বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু গল ফেস গ্রীনেও।
একপর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে পুলিশ ও দাঙ্গা স্কোয়াড মোতায়েন করা হয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করায় সরকার সমর্থকদের ওপর টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ।
শ্রীলঙ্কার পুলিশ জানিয়েছে, ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা সরকার সমর্থকদের ওপর হামলা এবং ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে পাল্টা জবাব দেয়। এছাড়া গাড়িতে হামলার পর দু’জন বিক্ষোভকারীকে গুলি করার পর আত্মহত্যা করেন শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন দলের একজন এমপি।
বিবিসি বলছে, সোমবার দিনব্যাপী সহিংসতার পর রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে শ্রীলঙ্কাজুড়ে বিক্ষোভকারীরা রাজাপাকসে-সহ দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রী ও এমপিদের বাড়িতে হামলা চালায়। এর মধ্যে দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা শহরে রাজাপাকসে পরিবারের পৈতৃক গ্রামে একটি বাড়িও রয়েছে। ওই বাড়িটিকে বিতর্কিত জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছিল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আগুন জ্বলতে থাকা বাড়িগুলোর সামনে লোকজন উল্লাস করছে। এছাড়া শ্রীলঙ্কার সরকারি বাসভবনের কাছাকাছি এলাকায়ও আগুন লাগানো হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গাড়িতে হামলার পর দু’জন বিক্ষোভকারীকে গুলি করার পর আত্মহত্যা করেন শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন দলের একজন এমপি।
কোথায় আছে রাজাপাকসে পরিবার?
সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়া মাহিন্দা রাজাপাকসে ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী।
রাজধানী কলম্বোয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনে রাতভর বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। এরপর মঙ্গলবার ভোরে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয় মাহিন্দা ও তার পরিবারের সদস্যদের।
তবে সেনাবাহিনী তাদের নিয়ে কোথায় গেছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। রাজপাকসে বা এই বাহিনীর পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ভোরে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে সেনাবাহিনী।
তিনি জানান, তাদের সরিয়ে নেয়ার আগে ওই বাসভবনের সামনে অন্তত ১০টি পেট্রল বোমা ছোড়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ।
পদত্যাগের পর মাহিন্দা রাজাপাকসে বাসভবন ছাড়লেও তার ছোট ভাই ও দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট ভবনেই রয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দেশটিতে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের কথা রয়েছে। গঠন করা হবে মন্ত্রিসভাও।
বেশ কিছুদিন ধরেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে উত্তাল শ্রীলঙ্কা; চলছে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন।
এক বৈঠকে গোতাবায়া সংকট সমাধানে বড় ভাই মাহিন্দাকে পদত্যাগ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন গত শুক্রবার। এর পরই সোমবার পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা। তবে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া পদ ছাড়ছেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
ডেইলি মিরর বলছে, পার্লামেন্টে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন প্রেসিডেন্ট। অবশ্য বিরোধী এসজেবি পার্টির নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা সম্ভাব্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না বলে জানিয়েছে তার দল।
করোনা মহামারি, উচ্চাভিলাষী ও অলাভজনক বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের বিনিয়োগ, ত্রুটিপূর্ণ করনীতি ও সরকারি অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপকভাবে কমে যায়। এর ফলে অনেকদিন ধরে জ্বালানি তেল, খাদ্য, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতে পারছে না দেশটি।
পাশপাশি, ঝড়ের গতিতে বাড়তে থাকা মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রে শুরু হয় ভয়াবহ আর্থিক ও মানবিক সংকট।
মাসের পর মাস ধরে এই অবস্থা চলতে থাকায় এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শ্রীলঙ্কার জনগণ। গত মার্চ থেকে শ্রীলঙ্কার ছোট-বড় সব শহরে শুরু হয় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। তাদের দাবি, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সবাইকে পদত্যাগ করতে হবে।
১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছে শ্রীলঙ্কা। কয়েক মাস ধরে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকটে পড়েছে দেশটি। ভয়াবহ বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের কবলে পড়েছেন শ্রীলঙ্কাবাসী।
এর প্রতিবাদে মাসখানেকের বেশি সময় ধরে শ্রীলঙ্কায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। গত ৯ এপ্রিল থেকে রাজধানী কলম্বোয় প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান নিয়ে আছেন বিক্ষোভকারীরা। গতকাল রাজধানীর বাইরে থেকে প্রধানমন্ত্রীর কয়েক হাজার সমর্থককে বাসে করে রাজধানীতে আনা হয়। তারা প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের পাশে অবস্থান নিয়ে থাকা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান। তাদের তাঁবু ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারবিরোধী ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবিতে অবস্থানরত ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালান তারা।
সংঘর্ষ থামাতে কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। তাৎক্ষণিকভাবে কলম্বোয় কারফিউ জারি করা হয়। পরে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ