ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকার তিনটি আইন, রেগুলেশন ও নীতিমালা করছে। এই আইন ও নীতিমালায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি স্পষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রস্তাবিত এই আইন, রেগুলেশন ও নীতিমালা তিনটি হলো, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের তৈরি ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট-২০২২, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-র তৈরি রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক সেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০২১।
ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যম আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি নতুন এই নীতিমালা তৈরি করেছে। এই তিনটি আইন ও নীতিমালার খসড়া নিয়ে ইতিমধ্যে নানা ধরনের সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন করে কখনো অপরাধ দমন করা যায় না। প্রত্যেকটা আইনের ‘হিডেন অ্যাজেন্ডা’ থাকে। সেটা এখানে স্পষ্ট হয়েছে।
যা বলা আছে প্রস্তাবিত আইনে
প্রস্তাবিত আইনে বলা আছে, ইন্টারনেটভিত্তিক যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে এখন বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে ডেটা সেন্টার বা উপাত্ত ভান্ডার স্থাপন করতে হবে। ডিজিটাল দুনিয়ায় মানুষের প্রকাশ্য বিচরণ এবং হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারসহ ব্যক্তিগত যোগাযোগমাধ্যমে নজর রাখা যাবে। সরকার চাওয়া মাত্রই তথ্য সরবরাহ করতে হবে। আইনে জেল-জরিমানার বিধান থাকছে।
জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমরা যে ডিজিটাল সিকিউরিট অ্যাক্ট করেছি, তখন এর ব্যাপকভাবে সমালোচনাও হয়েছে। আমিও অস্বীকার করব না, যে এর অপপ্রয়োগ হয়নি। আইন যখন হয়, তখন এর অপপ্রয়োগের সম্ভাবনাও থাকে। এটা সরকারের করতে হয় না। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে মামলা করে।
এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুই দিন পরপর যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হচ্ছে, গুজব ছড়ানো হচ্ছে, অপপ্রচার হচ্ছে তার জন্য সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার কি দরকার নেই? এটা কি লাগামহীন ছেড়ে দেওয়া যাবে? পৃথিবীর সব দেশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আমাকে কেউ উলঙ্গ স্বাধীনতা দেয়নি। সংবিধান আমাকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু উলঙ্গ হয়ে আমি হেঁটে যেতে পারি না।
যদি বাক স্বাধীনতা হরণ করা হতো তাহলে দেশে এই মিডিয়াগুলো টিকে আছে কেমনে? সব মিডিয়ার কি গলা আটকায় ধরা হয়েছে? বিদেশে বসে যখন যা খুশি তাই প্রচার করা হয়, এগুলো কি নিয়ন্ত্রণ করার দরকার নেই? আমাদের আসলে অপপ্রয়োগ প্রতিরোধ করা দরকার এবং অপপ্রয়োগ যাতে না হয় সেটিও নিশ্চিত করা দরকার।
ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট অনুযায়ী, দেশের ভেতর বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যে তথ্য ভান্ডার স্থাপন করবেন, সেটিতে বাংলাদেশের আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের প্রবেশাধিকার থাকবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার ভেতর তথ্য ভান্ডার রাখা নিয়ে শঙ্কার কারণ, ব্যক্তিগত উপাত্ত নিয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগায়, এমন অভিযোগ আছে।
খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে সময়-সময় প্রয়োজনীয় যেকোনো নির্দেশ দিতে পারবে। এর মাধ্যমে সরকারকে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। ফলে এখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হতে পারে বলেই শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
যে কারণে তৈরি হচ্ছে শঙ্কা
প্রস্তাবিত ঐ নীতিমালা নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিটিআরসি বলছে, হাইকোর্টের নির্দেশে সামাজিক মাধ্যম এবং অনলাইন প্লাটফর্মের কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে এই নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
তবে অনেকেই এই নীতিমালায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এতে আরো সংকুচিত হবে। কারণ, এখানে অপরাধের সুনির্দিষ্ট ব্যাখা না থাকায় আইন প্রয়োগকারীরা এটার অপব্যবহার করতে পারেন।
ব্যারিস্টার জোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, প্রত্যেকটা আইনের একটা হিডেন অ্যাজেন্ডা থাকে। এখানে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ চাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। বিটিআরসি যে রেগুলেশনটি করছে, বলা হচ্ছে সেটা উচ্চ আদালতের নির্দেশে করেছে। আমি ওই শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের এখানে ব্যবসা করে যাচ্ছে, অথচ রেভিনিউ দিচ্ছে না।
এখন যে ড্রাফটটা তৈরি করেছে, সেখানে রাজস্ব নিয়ে একটা শব্দও নেই। আল্টিমেটলি ওই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা চলে এসেছে। ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্টের কারণে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য প্রাপ্তির যে নিশ্চয়তা এই আইনের ফলে সেটাও বাধাগ্রস্থ হবে।
মন্ত্রী বলেছেন, সব আইনেরই অপপ্রয়োগ হয়, সেটা ঠেকানো দরকার। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার বড়ুয়া বলেন, এটা গতানুগতিক বক্তব্য। বহুকাল ধরে আমরা এই ধরনের কথা শুনে আসছি। আসলে এই আইনের ফলে আমরা যে একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হয়েছি, সেটাই আরো গতিশীল করবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনে অস্পষ্টতাই মানুষকে হয়রানির মুখে ফেলতে পারে। খসড়া আইন, রেগুলেশন ও নীতিমালা কার্যকর হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, বাক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার যে অধিকার, তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০২২-এর খসড়ার দিকে নজর রাখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপণ। নীতিমালার খসড়া পর্যালোচনা করে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখানে প্রোটেকশন নয়, বরং অরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে মানুষের তথ্য।
পাশাপাশি রেগুলেশন যেটা করা হয়েছে, সেখানে অপরাধের সংজ্ঞা অস্পষ্ট রাখা হয়েছে এবং সে কারণে অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকছে। বড় যে সমস্যা এখানে সেটা হচ্ছে, যে কাজগুলোকে অপরাধ হিসাবে বলা হচ্ছে, সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয়। এটা উদ্বেগের। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ফৌজাদারি কার্যবিধিতে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, আমাকে কেন কোন কাজ করতে নিষেধ করা হচ্ছে, তা আমাকে বুঝতে হবে।
কিন্তু এই নীতিমালায় কিছু বিষয়কে নিষেধ করা হচ্ছে, যেগুলোর পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, যে কাজটা আপাতত অপরাধ নয়, সেটাকেও নির্বাহী বিভাগ অপরাধ বলে মনে করতে পারে। যেভাবে আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হতে দেখেছি।
তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, “আমি মনে করি, এই আইনের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে। সাধারণ মানুষের স্বার্থ খুব একটা যুক্ত না। গত এক হাজার বছর ধরে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধই হয়। শুধু অপরাধের মাধ্যমটা বদলে যায়। এরজন্য নতুন কোনো আইনের দরকার নেই। এই অপরাধগুলো শনাক্ত করার সক্ষমতা দরকার। নতুন আইন করে কোনো অপরাধ দমন করা যায় না।
ডিজিটাল সিকিউরিট অ্যাক্ট করা হয়েছে, তাতে কি অপরাধ কমেছে? বরং বেড়েছে। এখন কিন্তু আমরা গ্লোবার ভিলেজে বাস করি। এই আইনগুলোর সঙ্গে কিন্তু গ্লোবাল অনেক প্লেয়ার জড়িত। তারা কোন দেশে সার্ভিস দেবে সেই সিদ্ধান্ত নেয় ওই দেশের লিগ্যাল সিস্টেম আর রেগুলেশনের উপর। আইসিটি সেক্টরে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বড় প্লেয়ার কিন্তু আসেনি। না আসার বড় কারণ সিদ্ধান্তের স্থায়ীত্ব না থাকা। হুটহাট করে আমরা নানা সিদ্ধান্ত নেই। ফলে তারা এখানে আসতে ভয় পায় এবং আসে না।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে যে ওটিটি কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০২১- এর খসড়া প্রকাশ করেছে, সেটি নিয়েও উদ্বেগ আছে। যদিও দাবি করা হয়েছে এই নীতিমালার উদ্দেশ্য, সৃজনশীলতা লালন, সৃজনশীল শিল্পকর্মে সহযোগিতা এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাকস্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা। কিন্তু বেশ কিছু শব্দের ব্যাখ্যা ও আওতা সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি।
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও আইনের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার ও অপব্যবহার বিশ্বের সব জায়গাতেই হয়। এই অপব্যবহার রোধ করার প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমরা যেটা দেখছি, আমাদের এখানে সরকারের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় নিয়ন্ত্রণের একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করি। সেটা আমাদের উদ্বিগ্ন করে, বিচলিত করে। এটা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের এই আশঙ্কা যে অমূলক, তা নয়।
এদিকে বাংলাদেশের সংবিধান গোপনীয়তার যে অধিকার দিয়েছে, প্রস্তাবিত ডেটা সুরক্ষা আইন সে গোপনীয়তার সুরক্ষা দেবে না। বরং ব্যক্তিগত তথ্য সরকারের মালিকানায় চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সোমবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক ভার্চ্যুয়াল সভায় এ কথা বলেছে। টিআইবি বলেছে, জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থার (আঙ্কটাড) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে ১৩৭টি দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বা তথ্যের গোপনীয়তা সম্পর্কে দেশীয় আইন রয়েছে। আঙ্কটাডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এ ধরনের আইন নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তাড়াহুড়ো করার কোনো সুযোগ নেই।
অংশীজনদের নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার পরই আইনটি চূড়ান্ত করা উচিত হবে। টিআইবি প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর ধারাগুলো চিহ্নিত করেছে। তারা বলেছে, আইনটি এভাবে পাস হলে তা একটি কালো আইনে পরিণত হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ