বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান, করোনায় বাংলাদেশে মারা গেছেন সরকারি হিসাবের ৫ গুণ বেশি মানুষ। প্রসঙ্গত, সারাবিশ্বে করোনা মহামারিতে আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর সংখ্যার পাশাপাশি প্রকৃত প্রাণহানির আনুমানিক সংখ্যা বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
সরকারি হিসাবে করোনাভাইরাস মহামারিতে গত দুই বছরে বাংলাদেশে যত মানুষ মারা গেছেন, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা তার চেয়ে আনুমানিক প্রায় পাঁচ গুণ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২০ ও ২০২১ সালে এক লাখ ৪১ হাজার মানুষ মারা গেছেন, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া মৃত্যু সংখ্যার প্রায় পাঁচগুণ। অধিদপ্তরের হিসেবে, ওই সময়ে করোনাভাইরাসে মোট ২৮ হাজার ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনটি ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ. এস. এম আলমগীর।
তিনি বলেন, “আমরা মৃত্যুর যে সংখ্যা বলছি তা থেকে শতকরা পাঁচ থেকে ১০ ভাগ কমবেশি হতে পারে। তবে তা কোনোভাবেই পাঁচগুণ হবে না।”
তার মতে, কোভিডের সময় কোনো মানুষ মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেও তাঁকে কোভিডে মৃত বলে ধরে নেয়া হয়েছে। “তাই এই প্রতিবেদন অগ্রহণযোগ্য।”
স্বাস্থ্য গবেষকরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা পদ্ধতি ঠিক আছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে অতিরিক্ত মৃত্যু সম্পর্কে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার জরিপ পদ্ধতি ঠিক আছে বলে আমি জানি। এই জরিপের সাথে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একজন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।”
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হবার পর যারা হাসপাতালে মারা গেছেন, তাদের পাশাপাশি যারা হাসপাতালে যেতে পারেননি বা করোনার লক্ষ্মণ নিয়ে মারা গেলেও পরীক্ষা করানো হয়নি তাদের সংখ্যাও এই জরিপে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান মোশতাক হোসেন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সরকারি সংখ্যা থেকে প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিতভাবে বেশি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তবে সেটি পাঁচগুণ বা তার চেয়ে কতগুণ কম অথবা বেশি সেটি গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “সরকারের উচিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই গবেষণার বিষয়টি যাচাই করতে আরেকটি গবেষণা করে এ ব্যাপারে তথ্য প্রকাশ করা। এর মাধ্যমেই করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে কত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন তা জানা সম্ভব।”
প্রতিবেদনটির গবেষণা পদ্ধতিতে বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশে আগের বছরগুলোতে বার্ষিক মৃত্যুর হিসাব থেকে অনুমান করা হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারি না আসলে ২০২০-২১ সালে আনুমানিক কতজন মানুষ মৃত্যুবরণ করতেন।
ওই দুই বছরে মোট মৃত্যুর সংখ্যা থেকে করোনা না থাকলে কত মানুষ মারা যেতেন সেই সংখ্যা বিয়োগ দিয়ে সম্ভাব্য করোনার কারণে মৃত মানুষের মোট সংখ্যা অনুমান করা হয়েছে। এরপর এই সংখ্যার সাথে সরকারি হিসাবে করোনায় মৃত মানুষের সংখ্যা তুলনা করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারিতে দেড় কোটি মানুষ মারা গেছেন, যা আনুষ্ঠানিক হিসাবে ৫৪ লাখ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিভিন্ন দেশ করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখিয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের মধ্যে মিশর সবচেয়ে কম মৃত্যুর সংখ্যা জানিয়েছে। দেশটিতে আনুষ্ঠানিক সংখ্যার চাইতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে ১১ গুণের বেশি। এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত, ভারতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আনুষ্ঠানিক সংখ্যার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। পাকিস্তানে আট গুণ এবং ইন্দোনেশিয়ায় সাতগুণের বেশি।
ভারত এই প্রতিবেদনের গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি জানালেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা জানতে ২০২০ সালে একটি জরিপ করা হয় বলে জানান পরিসংখ্যান বিভাগের সেন্সাস বিভাগের উপপরিচালক আলমগীর হোসেন।
তিনি বলেন, “সেখানে আমরা দেখেছি স্বাস্থ্য বিভাগের মৃত্যুর সংখ্যার চাইতে আমাদের হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা তখন ছয়শ জন বেশি।”
করোনাভাইরাসে ২০২১ সালে কত মানুষ মারা গেছেন তার ওপর পরিচালিত জরিপের ফলাফল হাতে আসেনি বলে জানান তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছে তাদের এলাকায় কত মানুষ করোনাভাইরাসে মারা গেছেন, এছাড়া তারা কবরস্থানে কর্মরত মানুষের সাথে কথা বলেছে বলে জানান আলমগীর হোসেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যাকে এক ধরনের অনুমান বা “হাইপোথিসিস” উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, তারা “নমুনা সংগ্রহ করে এই গবেষণা করেনি।”
তবে বাংলাদেশে কম সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করায় কম রোগী শনাক্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি, নমুনা বেশি নিলে শনাক্ত সংখ্যা বেশি হয়। সেকারণে আমরা সরকারকে বার বার বলেছি যাতে নমুনা সংগ্রহ বেশি করা হয়।”
বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। ১৮ মার্চ করোনাভাইরাসে প্রথম রোগীর মৃত্যু হয়।
এই অবস্থায় ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সারাদেশে লকডাউনের আদলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। জুন মাসে অর্থনীতি খুলে দিলে পুনরায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ওই বছর জুন-জুলাই-আগস্ট মাসে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ওই দফায় ৩০ জুন সর্বোচ্চ ৬৪ জন মানুষ করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর থেকে সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমে আসে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে ২০২১ সালের ১০ আগস্ট একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জন মৃত্যুবরণ করেন। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে পুনরায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। তবে এই সংক্রমণ তেমন তীব্র হয়নি। ৮ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ ৪৩ জন করোনায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে এবং বর্তমানে তা প্রায় শূন্যের কোটায়।
শুক্রবার পর্যন্ত গত ১৬ দিন একটানা করোনায় কোন প্রাণহানি ঘটেনি বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, নতুন করে ১৯ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার মাত্র চারজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে শুক্রবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ২৯ হাজার ১২৭ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এপর্যন্ত করোনাভাইরাসে সাড়ে ১৯ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বর্তমান সময় পর্যন্ত ২৫ কোটির বেশি টিকা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তৃতীয় বুস্টার ডোজ দেয়া চলছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৪৬
আপনার মতামত জানানঃ