আজ ৮ মে পালিত হবে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস-২০২২। থ্যালাসেমিয়া রক্তস্বল্পতাজনিত বংশগত রোগ। বাবা-মা উভয়ে যদি ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করেন তাহলে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে।
সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশে এই রোগের বাহকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাপক জনগোষ্ঠী এখনো এই রোগ সম্পর্কে সচেতন নয় এবং বাহক নির্ণয় হয়নি। ফলে বাহকের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে।
এবারের থ্যালাসেমিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হচ্ছে—‘থ্যালাসেমিয়া: নিজে জানি, যত্নবান হই এবং অপরকে সচেতন করি’। দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগী
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রতিষ্ঠিত কোনো ডাটা নেই। তবে আমাদের পর্যবেক্ষণ, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ১২ শতাংশ মানুষ এই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক, কিন্তু তারা থ্যালাসেমিয়ার রোগী নন। প্রতি বছর এই রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে ১০ থেকে ১২ হাজার শিশু।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক।
এছাড়া থ্যালাসেমিয়া বাহকদের পরস্পরের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর নতুন করে ৭ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম হচ্ছে।
থ্যালাসেমিয়া রোগীরা প্রতি মাসে এক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। চিকিৎসা না করা হলে এ রোগীরা রক্তশূন্যতায় মারা যায়।
উপসর্গ কী কী?
থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই প্রকার। আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলফা থ্যালাসেমিয়া তীব্র হয় না। অনেক সময় উপসর্গও বোঝা যায় না, রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করে।
তবে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই বিটা থ্যালাসেমিয়ায় ভুগে থাকে। এই থ্যালাসেমিয়া আবার দুই রকম হতে পারে। যারা বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনরে আক্রান্ত, তাদের থ্যালাসেমিয়ার ক্যারিয়ার বা বাহক বলা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এদের শরীরে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
অনেকে অজান্তেই সারা জীবন এই রোগ বহন করে চলে। কখনো মৃদু রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। অপরটি হলো থ্যালাসেমিয়া মেজর। মা ও বাবা উভয়ই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে শতকরা ২৫ ভাগ। বাহক হওয়ার ঝুঁকি থাকে শতকরা ৫০ ভাগ।
থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গগুলো মূলত রক্তস্বল্পতাজনিত উপসর্গ। যেমন ক্লান্তি, অবসাদ, শ্বাসকষ্ট, ফ্যাকাশে ত্বক ইত্যাদি। রক্ত অধিক হারে ভেঙে যায় বলে জন্ডিস হয়ে ত্বক হলুদ হয়ে যায়। প্রস্রাবও হলুদ হতে পারে। প্লীহা বড় হয়ে যায়। যকৃৎও বড় হয়ে যেতে পারে। অস্থির ঘনত্ব কমে যেতে পারে। নাকের হাড় দেবে যায়, মুখের গড়নে পরিবর্তন আসে। শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। দিনে দিনে জটিলতা বাড়তে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসারও আছে প্রতিক্রিয়া। এসব রোগীকে ঘন ঘন রক্ত দিতে হয় বলে শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই বাড়তি আয়রন জমা হয় হৃদযন্ত্র, যকৃৎ ও অগ্ন্যাশয়ে। অতিরিক্ত আয়রন জমায় অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে। তা ছাড়া বারবার রক্ত পরিসঞ্চালনের কারণে রোগীর রক্তবাহিত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
থ্যালাসেমিয়া শনাক্তে রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করা হয়। রক্তের রুটিন পরীক্ষা (সিবিসি) থেকে থ্যালাসেমিয়া সন্দেহ করা যেতে পারে। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা করেও এই রোগ ধরা যায়।
নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, আমরা ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে এখনো সচেতন করতে পারিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই রোগটিকে গুরুত্ব দিয়েছে। এই রোগ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে জেলা উপজেলা পর্যায়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
পাশাপাশি বাহক নির্ণয় করতে হবে এবং বাহকে বাহকে বিয়ে বন্ধ করতে পারলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
থ্যালাসেমিয়া রোগের একমাত্র চিকিৎসা—বোনম্যারু ট্রান্সপ্ল্যান্ট, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের মধ্যে এখনো বোনমেরু ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু হয়নি। অন্য যে চিকিৎসা তাও ব্যয়বহুল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা প্রটোকল মেনে চিকিৎসা দিলে একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগী দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। আর এই রোগীদের বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তাদের প্রধান উপাদান হচ্ছে নিরাপদ রক্ত।
সারা জীবন এই রোগীদের অন্যের রক্তে বেঁচে থাকতে হয়। বারবার রক্ত নেওয়ার ফলে তাদের শরীরে কিছু অঙ্গে ক্ষতিকর আয়রণ জমে যায়, এই অপ্রয়োজনীয় আয়রণ বের করতে কিছু ওষুধ তাদের খেতে হয়, যা অনেক দামি।
তবে আশার কথা হচ্ছে, এখন ঐ ওষুধগুলো আমাদের দেশেই তৈরি হয়। তবে তা ব্যয়বহুল। এছাড়া তাদের খাদ্যাভাস ভালো রাখতে হয় এবং নিয়মিত টেস্ট করাতে হয়। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রফুল্ল জীবন যাপন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বংশানুক্রমের ব্যাপারটা হলো—বাবা-মা দুই জনেই যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হয় তাহলে কিছু সন্তান সুস্থ হবে, আবার কিছু সন্তান রোগী অথবা বাহক হবে। বাবা-মা দুই জনই যদি রোগী হয় তাহলে সুস্থ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আবার যদি মা-বাবার একজন রোগী হয়, অন্যজন সুস্থ হয় তাহলে কিছু সন্তান বাহক হবে; কিন্তু সুস্থ হবে। তার মানে হলো রোগটি মা-বাবার থেকেই বাচ্চার মধ্যে সঞ্চালিত হয়।
তাই যদি বিয়ে করার আগে রক্তের পরীক্ষা করে নেওয়া যায় যে, পাত্র বা পাত্রী কেউই বাহক বা রোগী নয়, তাহলে রোগটি সঞ্চালিত হতে পারবে না।
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক, ডা. এ কে এম একরামুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ে সরকারি যে হাসপাতালগুলো আছে সেখানে একটি করে থ্যালাসেমিয়ার সেন্টার করা হোক। যেখানে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের আধুনিক প্রটোকল অনুযায়ী বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আমাদের ৬ হাজার রেজিস্টার্ড থ্যালাসেমিয়ার রোগী আছে, যাদের ৮০ ভাগ রোগীর আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। সেই রোগীরা যেন জেলা পর্যায়ে আধুনিক প্রটোকল মেনে চিকিৎসা নিতে পারে। এছাড়া জেলা উপজেলা পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করে, বাহক নির্ণয় করতে পারি এবং বাহকে বাহকে বিয়ে বন্ধ করতে পারলে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ