তালিবান দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখলের পর এই প্রথম ঈদ উদযাপন করল আফগানবাসী। আফগানিস্তান জুড়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় রাজধানী কাবুলের বৃহত্তম মসজিদে বেশ ভয়ে ভয়েই ঈদের নামাজ আদায় করতে গেছেন মুসল্লিরা।
অবশ্য সেখানে ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করে ছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। বার্তা সংস্থা এপি সোমবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
সম্প্রতি বেশ ঘন ঘন ঘটা বিস্ফোরণ প্রভাবিত করেছে এবারের ঈদকে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস)চালানো এসব হামলার লক্ষ্য শিয়া সম্প্রদায়ের হাজরা কমিউনিটির সদস্যরা। এইসব হামলার কারণে এবারে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া নিরাপদ কী না তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
কাবুলের একটি মসজিদে গত শুক্রবারই জুমার নামাজের সময় শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মুসল্লি নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অনেক মুসল্লি।
অবশ্য এসব আতঙ্ক পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে কমিউনিটি নেতা ড. বকর সাইদ ঈদের প্রাক্কালে বলেন,আমরা আমাদের প্রতিরোধ দেখাতে চাই, তারা আমাদের দূরে ঠেলে দিতে পারবে না। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
যদিও এসব সহিংসতায় আফগানদের উদ্বেগের একমাত্র কারণ নয়। তালিবান গত বছরের আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। বেড়েছে খাদ্যদ্রব্যের দাম। মুদ্রাস্থীতি হয়েছে লাগাম ছাড়া।
লাখ লাখ আফগান নাগরিকের জীবনে ঈদ যেন কোনো আনন্দই বয়ে আনতে পারেনি। খুশি বা আনন্দ আসবেই বা কিভাবে? দিন কাটছে খাবারের অভাবে। একবেলা ঠিক মতো খাবার না জুটলে ঈদের আনন্দও তখন ফিকে হয়ে যায়।
গত রোববার (১ মে) ঈদ উদযাপন করেছে আফগানিস্তানের মানুষ। কিন্তু লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ঈদের কোনো আমেজ দেখা যায়নি। প্রায় প্রতিদিনই তিনবেলা খাবারের জন্য তাদের লড়াই করতে হচ্ছে।
জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কাবুলের একটি বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে শনিবার ১০ সন্তানের বাবা দ্বীন মোহম্মদ এবারের ঈদ দুর্বিষহ হতে যাচ্ছে আশঙ্কা করে বলেছিলেন, দারিদ্র্যের কারণে কেউ আগের মতো ঈদ উদযাপন করতে পারে না। আমাদের যদি চাকরি আর কাজ থাকত, তাহলে আমরা নিজেদের জন্য কিছু কিনতে পারতাম। অন্যের দেওয়া খাবারের আশায় বসে থাকতে হতো না।
৩৮ বছর বয়সী এক আফগান নাগরিক জানান, দিন দিন সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার ধারণ করছে। তার পরিবারে ১৭ জন সদস্য। বাড়ির কাছের একটি বেকারি থেকে তিনি তার পরিবারের জন্য মাত্র কয়েক টুকরো রুটি জোগাড় করতে পারেন। পরের বেলা কি খাবেন সেটাও তারা জানেন না। সেজন্য ওই সামান্য রুটি থেকেও তাদের কিছু রেখে দিতে হয়। যদি কোনো বন্ধু-বান্ধব বা স্বজন কখনও কিছু দেয় তাহলে তাতে বেশ উপকার হয়। কিন্তু সেটা তো সব সময় হয় না।
তিনি বলেন, ঈদে এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার আশাও আমরা করি না। কারা আমাদের সাহায্য করবে বা টাকা দেবে? পুরো শহরের মানুষইতো ক্ষুধা আর দরিদ্র অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি যে শরণার্থী শিবিরে বড় হয়েছি সেখানেও এত খারাপ পরিস্থিতি দেখিনি। এর আগে তিনি পাকিস্তানের একটি শরণার্থী শিবিরে ছিলেন বলে জানান।
এর আগে তিনি একটি সরকারি চাকরি করতেন। কিন্তু পুরো রমজানজুড়েই তিনি কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি। সেহেরি বা ইফতারে একটু খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি দিনরাত এখানে সেখানে কাজ খুঁজেও ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি জানান, এবারের রমজান মাস তার জীবনে সবচেয়ে খারাপ কেটেছে। এর আগে কখনও তাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। গত রমজানেও তিনি তার পরিবার নিয়ে নামাজ পড়েছেন, ঘরে খাবার ছিল, খুব বেশি কিছু না থাকলেও বেশ শান্তি ছিল। কিন্তু এবার কিছুই নেই।
তিনি বলেন, এই রমজান ছিল সবচেয়ে খারাপ সময়। শুধু যে আমরা খাবারের কষ্ট করছি তা নয়, এখন কারও মধ্যে কোনো ঐক্যও নেই। সম্প্রতি মসজিদে হামলার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আমরা শান্তিতে নামাজ আদায়ও করতে পারছিনা।
তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর চাকরি হারান জামাল (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, আমি সব সময়ই চেয়েছিলাম দেশের জন্য কাজ করতে। আমি সামরিক বাহিনীতে ছিলাম না বা কোনো রাজনৈতিক গ্রুপেও ছিলাম না। কিন্তু তারপরেও তারা (তালিবান) আমার চাকরি কেড়ে নিয়েছে।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এই ব্যক্তি কাজ হারানোয় তার পরিবার মহা বিপদে পড়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের পথে বসতে হয়েছে। তিনি বলেন, তালিবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমার পরিবারের সদস্যরা কখনও পেট ভরে খাবার খেতে পারেনি। এই পুরো রমজানেই আমরা ইফতার করেছি শুধু পানি আর রুটি দিয়ে। ঈদেও কোনো কিছু বদলায়নি। আমাদের জীবনে এখন আর ঈদের কোনো আনন্দ নেই।
তিনি বলেন, গত রমজানের শেষের দিকে আমরা শিশুদের জন্য এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনাকাটা করেছি। এমনকি পরিবার নিয়ে ইফতারও বাইরে করেছি। আর এবার আমরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৫
আপনার মতামত জানানঃ