ইউক্রেনে রুশ অভিযানের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমাদের সঙ্গে নতুন করে নাটকীয়ভাবে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে রাশিয়ার। এরই মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। এদিকে পশ্চিমাদের আশঙ্কা ছিল, তাদের শায়েস্তা করতে জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে রাশিয়া। এমন ইংগিত দেয়া হয়েছিল ক্রেমলিনের পক্ষ থেকেও।
ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান জোগানদাতা রাশিয়া। পশ্চিমা বিধি-নিষেধের মধ্যে রুবল দর হারালে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়ে দেন, বন্ধু নয়, এমন রাষ্ট্রকে রুশ জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে হলে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলেই কিনতে হবে।
এবার সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম রুবলে দিতে অস্বীকার করায় পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া।
বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে রাশিয়া—এ ঘোষণার পর পরই ইউরোপে গ্যাসের মূল্য ২৪ শতাংশ বেড়েছে।
পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া তাদের দেশে রুশ গ্যাস সরবরাহ বন্ধের কথা জানালেও মস্কোর তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পোল্যান্ডের রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানি পিজিএনআইজি জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বুধবার সকাল ৮টা থেকে দেশটিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে মস্কো। বুলগেরিয়ার জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদেরও বুধবার থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের কথা জানিয়ে দিয়েছে গ্যাজপ্রম।
সম্প্রতি ‘অবন্ধুসুলভ’ দেশগুলোকে রুশ জ্বালানি নিতে হলে ডলারের বদলে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলে অর্থ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা আরোপের ঘোষণা দেয় মস্কো। অন্যথায় তাদের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে মস্কোর ওই শর্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। এরপরই উভয় দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় গ্যাজপ্রম।
বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে রাশিয়া—এ ঘোষণার পর পরই ইউরোপে গ্যাসের মূল্য ২৪ শতাংশ বেড়েছে।
রাশিয়ার ওপর ইইউ- এর নিষেধাজ্ঞায় পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া সমর্থন দিয়েছে। উভয় দেশই এসময় প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা এখন থেকে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার বিপুল সরবরাহ অন্য উৎস থেকে মেটাতে পারেনি। তার আগেই উল্টো আঘাত হানলো ক্রেমলিন। দেশ দুটির অর্থনীতিতে পড়তে চলেছে যার মারাত্মক প্রভাব। ইউরোপের অন্যান্য দেশের সামনেও এখন অশনি বার্তা। তারাও সরবরাহ বন্ধের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এদিকে গ্যাজপ্রমের সিদ্ধান্তের পর, বিদ্যুৎ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে জ্বালানি বাজারে। ইউরোপে গ্যাসের মূল্য সূচকগুলো সার্বিকভাবে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত নাটকীয় হারে বেড়ে প্রতিমেগাওয়াট ঘণ্টা হিসাবে ১২১ ইউরোতে উন্নীত হয়েছে। চলতি মাসে ইউরোপে গ্যাসের বাজারে এটিই সবচেয়ে বড় মূল্যস্ফীতি, এক বছর আগের তুলনায় যা সাতগুণ বেশি।
রাশিয়ার সরবরাহ হারিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে চলেছে পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। ইইউ জোটের সামনেও হয়তো অপেক্ষা করছে একই পরিস্থিতি।
তুলনামূলক দুর্বল বুলগেরিয়ার ওপর চাপ আরও বেশি। দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী আলেক্সান্ডার নিকোলোভ বুধবার সাংবাদিকদের জানান, গত ১ এপ্রিল থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম ইতোমধ্যেই তার দেশ রাশিয়াকে দিয়েছে। একারণে, সরবরাহ বন্ধ করা হলো গ্যাজপ্রমের সাথে বর্তমান চুক্তির লঙ্ঘন।
রুবলে মূল্য পরিশোধ না করার ইউরোপীয় কমিশনের সিদ্ধান্তের পক্ষেই বুলগেরিয়ার অবস্থান থাকবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে দেশটি রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল। ৬৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটির ৯০ শতাংশ গ্যাস চাহিদা পূরণ হয় রাশিয়া থেকে আমদানির মাধ্যমে। নিকোলোভ মন্তব্য করেন যে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদকে ব্যবহার করছে।
বর্তমান মজুদে তার দেশের অন্তত এক মাসের চাহিদা মেটানো যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
বিকল্প উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহে ইইউ সাহায্য করবে বলেও আশাপ্রকাশ করেন বুলগেরীয় জ্বালানিমন্ত্রী।
এরমধ্যেই গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস তার বুলগেরীয় সহকর্মীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, নিজস্ব গ্যাস মজুদ নিয়ে গ্রীস তার দেশের পাশে এসে দাঁড়াবে।
উভয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ফোনালাপে এ আশ্বাস দেওয়া হয়।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আগামী তিন বছর খাদ্য ও জ্বালানির দাম অপেক্ষাকৃত বেশি থাকবে। বুধবার (২৭ এপ্রিল) এমন সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। বৈশ্বিক অর্থনীতি ১৯৭০-এর দশকের মতো উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং দুর্বল প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হওয়ার ভীতি জোরালো হচ্ছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থাটির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, অধিক দামের প্রবণতা ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ চলতে পারে। আর এর সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতিও অব্যাহত থাকতে পারে।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের জেরে বাণিজ্য ও উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় এই বছর জ্বালানির দাম ৫০ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করছে বিশ্ব ব্যাংক। তাদের ধারণা অপরিশোধিত জ্বালানির গড় দাম ২০২২ সালে ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলারে দাঁড়াবে। ২০১৩ সালের পর এটিই সর্বোচ্চ এবং ২০২১ সালের তুলনায় এই দাম ৪০ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে এই দাম ৯২ ডলারে নামতে পারে। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরের এর গড় দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৬০ ডলার। অর্থাৎ, ২০২৩ সালে দাম কমলেও তা হবে গত পাঁচ বছরের দামের চেয়ে ঢের বেশি।
ইউরোপের বাজারে গ্যাসের দাম ২০২২ সালের দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর কয়লার দাম বাড়বে ৮০ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের ধারণা, এই বছর গমের দাম বাড়বে ৪০ শতাংশের বেশি। এতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম আমদানির ওপর নির্ভর করা উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর ওপর চাপ বাড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৮
আপনার মতামত জানানঃ