সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গৃহবন্দি থাকা মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চিকে আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত। ৬ লাখ ডলার ও ১১ দশমিক ৪ কেজি সোনা ঘুষ নেওয়ার অপরাধে তাকে এ সাজা দেওয়া হয়। দুর্নীতির দায়ে দেশটির আদালত বুধবার (২৭ এপ্রিল) সু চির বিরুদ্ধে এই দণ্ড ঘোষণা করেছেন। খবর রয়টার্স
সু চির বিরুদ্ধে দুর্নীতির ১১টি মামলার প্রথমটির রায় আজ ঘোষণা করা হলো। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে পাঁচ বছর মিয়ানমারের নেতৃত্ব দেন এই নোবেলজয়ী। তার বিরুদ্ধে ১৮টি অভিযোগ আনা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে এসব মামলায় তার সর্বোচ্চ ১৯০ বছর সাজা হতে পারে।
আদালত বসার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিচারক রায় ঘোষণা করেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়। রুদ্ধদ্বার বিচারকাজ চলায় সূত্রটি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি। বিচার সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ রয়েছে।
এখন পর্যন্ত অং সান সু চি দুটি তুলনামূলক ছোট অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং তার ছয় বছরের সাজা হয়েছে। অন্য মামলাগুলোর রায় হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এতে দেশটির স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সু চির রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ নেই বললেই চলে।
মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ইয়াঙ্গুনের সাবেক চিফ মিনিস্টার ফিও মিন থেইনের কাছ থেকে ৬ লাখ ডলার ও ১১ দশমিক ৪ কেজি সোনা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে সু চির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। একসময় ফিওকে সু চির উত্তরসূরি মনে করা হতো।
গত বছরের অক্টোবরে দেওয়া সাক্ষ্যে তিনি সু চিকে ঘুষ দেওয়ার কথা ‘স্বীকার’ করেছিলেন। তবে ওই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন সু চি।
সু চির বিচার-সম্পর্কিত তথ্যের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সেনা সরকার।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিচারকে প্রহসন আখ্যা দিয়েছে। তবে সেনা সরকারের দাবি, যথাযথ নিয়ম মেনেই একটি স্বাধীন আদালতে সু চির বিচার হচ্ছে। ৭৬ বছর বয়সী সু চিকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে।
এদিকে, কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই সাজা কার্যকর করতে ৭৬ বছর বয়সী সু চিকে এখন কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কি-না সেটি তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ২০২১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গ্রেপ্তারের পর থেকে সু চিকে একটি অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছে।
অবশ্য সু চির রায়ের বিষয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের কোনো মন্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
এখন পর্যন্ত অং সান সু চি দুটি তুলনামূলক ছোট অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং তার ছয় বছরের সাজা হয়েছে। অন্য মামলাগুলোর রায় হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
এর আগে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানি দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং কোভিড-১৯ প্রোটোকল লঙ্ঘনের মাধ্যমে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ভাঙার দায়ে গত ৬ ডিসেম্বর সু চিকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন দেশটির একটি আদালত। সরকারের শীর্ষ পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ১১ মাসের মাথায় তার বিরুদ্ধে দেওয়া প্রথম কোনো রায় ছিল সেটি।
তবে সু চির বিরুদ্ধে এই রায়ের পর বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সেসময় আদালত সু চিকে চার বছরের কারাদণ্ড দিলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে দুই বছর কমিয়ে দেয় মিয়ানমারের জান্তা সরকার।
পরে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি অং সান সু চিকে আরও চার বছরের কারাদণ্ড দেয় দেশটির একটি আদালত। অবৈধ ওয়াকিটকি রাখাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে এই কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এতে সু চির কারাদণ্ড দাঁড়িয়েছিল ছয় বছরে।
গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হয় ৭৬ বছর বয়সী নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি পার্টি। ভূমিধস জয়ের পর তারা সরকার গঠন করে। কিন্ত চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী।
সে সময় সু চি সহ অন্যান্য নেতাদের আটক করা হয়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত গৃহবন্দি রয়েছেন সু চি। এরপরেই একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ, গোপনীয়তা লঙ্ঘন জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ আনা হয় সু চির বিরুদ্ধে।
গৃহবন্দির পর থেকেই সু চিকে খুব একটা দেখা যায়নি। যদিও জান্তা সরকার দাবি করেছে যে, সু চি সুস্থ আছেন এবং এরই মধ্যে তাকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনও দেওয়া হয়েছে।
ক্ষমতা দখলের পরপরই গৃহবন্দি করা হয় অং সান সু চিকে। গ্রেপ্তার হন তার দল এনএলডির বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক।
সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই সু চি ও তার দল এনএলডির গ্রেপ্তার সদস্যদের মুক্তির দাবিতে মিয়ানমারজুড়ে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন; এবং কঠোর হাতে সেই আন্দোলন দমনে তৎপর হয় জান্তা।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ দমনে সেনা-পুলিশের অভিযানে এক হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। কারাবন্দি রয়েছেন কয়েক হাজার।
তবে মিয়ানমারের পরিস্থিতি তাতে শান্ত হয়নি। এখনও দেশটিতে আন্দোলন চলছে এবং সামরিক সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে ইতোমধ্যে একটি ছায়া সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন জান্তাবিরোধীরা।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এরপর সামরিক বাহিনীর দমনপীড়নে ১ হাজার ৭০০–এর বেশি মানুষ নিহত হন। গ্রেপ্তার করা হয় ১০ হাজার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ