পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পরপরই রাজ্য বিজেপিতে ভাঙনের ঢেউ লাগে। রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল দলটি, কিন্তু ২০০ আসন জেতা তো দূর, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কার্যত পর্যুদস্ত হয়েছে বিজেপি। আর তারপর থেকেই বিজেপি ছাড়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে।
এদিকে একের পর এক কংগ্রেস নেতা-নেত্রীকে নিজের দলে ভেড়াচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে দূরত্ব বাড়ছে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে। আবার একইভাবে চড়া হচ্ছে তার বিজেপিবিরোধী সুর।
পশ্চিমবঙ্গে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে পরাজয়ের পরে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রকাশ্যেই দলের বর্তমান সভাপতিকে তার নীতি পরিবর্তন করতে পরামর্শ দিলেন। অন্যদিকে আরেকজন সাবেক নেতার দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে অংশগ্রহণ নেতা–কর্মীদের আরও হতাশ করেছে।
দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচনেই ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির। আর এরপরই প্রকাশ্যে এল দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজেপি বেশ কিছু সদস্য বিজেপি প্রার্থীদের এই হারের জন্য দায়ী করেছেন রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের।
বিজেপির এমন অন্তর্দ্বন্দ্বে মূলত শক্তি বাড়ছে তৃণমূল কংগ্রেসের। গত বৃহস্পতিবার(২১ এপ্রিল) ইফতার আয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ দিয়ে সেই ইঙ্গিত দিলেন।
অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া বিজেপির তিন নেতার একজন হলেন দলের বর্তমান রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। বাকি দুজনও দলটির সভাপতি ছিলেন। তারা হলেন দিলীপ ঘোষ ও তথাগত রায়।
তথাগত রায় সাবেক রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের উদ্দেশে কয়েক দিন আগে টুইটে বলেছিলেন, ‘ফিটার মিস্ত্রি যেন বালিগঞ্জ বিধানসভা নির্বাচনে প্রচার করতে না যায়।’
পেশায় প্রকৌশলী তথাগত রায় অতীতে ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যের রাজ্যপাল ছিলেন। তিনি দিলীপ ঘোষকে সাধারণত ‘ফিটার মিস্ত্রি’ বলে সম্বোধন করেন। বিজেপির বর্তমান দুরবস্থার জন্য তথাগত রায় দিলীপ ঘোষকে দায়ী করেন। টুইটের মন্তব্যের পর সমালোচনার জবাবে গত বৃহস্পতিবার তিনি এ–ও বলেন যে তিনি কোনো অবস্থাতেই ফিটার মিস্ত্রির কাছে ক্ষমা চাইবেন না।
তথাগত রায়ের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দিলীপ ঘোষ বলেছেন, সারা দিন বাড়িতে বসে টুইট করলেই বড় নেতা হওয়া যায় না। যে দলীয় কর্মীরা মার খাচ্ছেন, মাঠে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হয়। দিলীপ ঘোষ আরও অভিযোগ করেন, তথাগত রায় একজন ‘পানাসক্ত’ ব্যক্তি, যিনি ‘দলীয় দপ্তরকে মদ খাওয়ার দপ্তর বানিয়ে তুলেছিলেন।
দিলীপ ঘোষের সঙ্গে সুকান্ত মজুমদারের বিরোধও জোরালো হচ্ছে। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে পরাজয়ের পরে দিলীপ ঘোষ বলেছেন, সুকান্ত মজুমদার সবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু তাঁর জানা উচিত যারা এত দিন আন্দোলন করেছেন, তাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সুকান্ত অবশ্য ওই মন্তব্যের কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাননি।
দলীয় নেতাদের অনেকের অভিযোগ, সুকান্ত মজুমদার দলকে সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। একদিকে একের পর এক দলীয় নেতা–কর্মীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে বিজেপির ভোট ধারাবাহিকভাবে কমছে, দ্বিতীয় স্থানে চলে আসছে সিপিআইএম।
এ পরিস্থিতির জন্য বিজেপির ভেতরে এখন সুকান্ত মজুমদারকে দোষারোপ করা হচ্ছে। কারণ, তিনি দলের রাজ্য সভাপতি। পাশাপাশি দিলীপ ঘোষের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। কারণ, তাঁর আমলেই বিজেপির ভোটের হার ১০ থেকে ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচনেই ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির। আর এরপরই প্রকাশ্যে এল দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজেপি বেশ কিছু সদস্য বিজেপি প্রার্থীদের এই হারের জন্য দায়ী করেছেন রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের।
বিজেপির ধারাবাহিক পরাজয়, ভোট কমে আসা এবং নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ বিরোধ তৃণমূলের আত্মবিশ্বাস যে ক্রমে বাড়াচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। এ আত্মবিশ্বাসের নজির দেখা গেল গত বৃহস্পতিবার। পরপর দুই বছর বন্ধ থাকার পরে এদিন কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ইফতারে যোগ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বেশি প্রচার পাওয়া সম্মেলন হলো বিনিয়োগ টানার অনুষ্ঠান-বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। সেই সম্মেলনের মাঝেই পার্ক সার্কাস ময়দানে কলকাতা পৌরসভার ইফতারে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। অতীতের মতোই তাকে দেখা গেল মাথায় সাদা কাপড় দিয়ে ইফতার করতে।
যদিও বলা হয়, করোনার কারণেই গত দুই বছরে মমতা ইফতারে যাননি, কিন্তু তার কাছের লোকেরাই মনে করেন এর কারণ অন্য। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায় কাপড় দিয়ে ইফতার করার ছবি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তারা মমতাজ বেগম বলেও ডাকতে শুরু করেছিল। সেই সময় বিজেপির ভোট, বিশেষত হিন্দু ভোট বাড়ছিল। আর তৃণমূলের হিন্দু ভোট কমছিল। অর্থাৎ বিজেপির লাগাতার প্রচারে হিন্দুসমাজের একটা অংশ মনে করতে শুরু করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন মুসলমান-ঘনিষ্ঠ নেতা। জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস।
বিপদটা বুঝতে পেরে, মুখ্যমন্ত্রীও রাতারাতি প্রকাশ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে এবং ইফতারে যাওয়া বন্ধ করে দেন। বিজেপির দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে আবার মঞ্চে ফিরলেন মমতা, যোগ দিলেন কলকাতা শহরে ইফতার আয়োজনে।
এদিকে কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে উঠতে চায় তৃণমূল। দলীয় মুখপত্রে তার ব্যাখ্যা দিল তারা। বুধবার(২০ এপ্রিল) সকালে প্রকাশিত তৃণমূলের দলীয় মুখপত্রে লেখা হয়েছে, ‘কংগ্রেস উদাসীন, রণক্লান্ত, ভারাক্রান্ত, অন্তর্দ্বন্দ্ব আর দলীয় জটিলতায় বিদীর্ণ। যেন ব্যাটন বইতে অপারগ। কিন্তু সময় পড়ে থাকে না। কাউকে এগিয়ে আসতেই হয়। তৃণমূল কংগ্রেস সেই দায়িত্ব পালন করবে। তারাই আসল কংগ্রেস।’
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার দিল্লিতে পা দিয়েই সংসদীয় দলের বৈঠক করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, বৈঠকে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে বিজেপি বিরোধিতায় সরব হতে বলেছেন। তাই সেই বৈঠকের রেশ ধরেই লেখা হয়েছে দলীয় মুখপত্রের সেই সম্পাদকীয়। আর সেই সম্পাদকীয়তেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূলের অবস্থান।
আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, বৈঠকের কথা উল্লেখ করে ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছে, দিল্লিতে সংসদ ভবন চত্বরে বসে দলের সর্বভারতীর সাধারণ সম্পাদক সাফ জানালেন, তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের শক্তি বাডা়বে। দল মনে করে, দেশের প্রধান শত্রু ভারতীয় জনতা পার্টি। সেই দলকে ২০২৪-এর ভোটে দিল্লির মসনদ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। নইলে গণতন্ত্রের বিপদ। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিপদ। বিপদ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির।’
অভিষেকের নেতৃত্বে যে ভিন্ রাজ্যেও তৃণমূল নিজের শক্তি বাড়াচ্ছে, তারও উল্লেখ করা হয়েছে সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে। লেখা হয়েছে, ‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস তার শক্তি বাড়াচ্ছে। ত্রিপুরা, মেঘালয়, গোয়া তার প্রকৃষ্ট উদাহারণ। এর পর হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, অসমে তৃণমূল কংগ্রেস তার অস্বিস্ত জানান দেবে।’ নিজেদের শক্তি বাড়ালেও, কংগ্রেসকে সূক্ষ্ম বার্তাও দেওয়া হয়েছে এই সম্পাদকীয়তে। প্রতিবেদনের শেষে লেখা হয়েছে, ‘যদিও সকলকে সঙ্গে নিয়েই চলতে চান অভিষেক।’
একের পর এক উইকেট পড়ায় দেশের প্রাচীনতম দল কংগ্রেস ক্রমশই জাতীয় রাজনীতিতে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। অপরদিকে, বাংলার বুকে কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া তৃণমূল আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে দেশে বিজেপিবিরোধী রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে। আঞ্চলিক দলের তকমা ঝেড়ে তৃণমূল এখন সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার পথে। চব্বিশের লোকসভা ভোটে মোদিবিরোধী জোটে সোনিয়া, রাহুল কিংবা প্রিয়াঙ্কা নন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এখন মুখ।
২০২৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি রাজ্যে তৃণমূল শুধু রাজনৈতিক শাখা বিস্তার নয়; বরং সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রভাবশালী নেতৃত্বের হাতে তৃণমূল কংগ্রেসের দায়িত্ব দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে জোর লড়াইয়ে নামারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৯
আপনার মতামত জানানঃ