সোলার জিওইঞ্জিনিয়ারিং বা সোলার রেডিয়েশন ম্যানেজমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দুর্বল দেশগুলোর মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে নতুন করে শত কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে সৌর বিকিরণ ব্যবস্থাপনার জন্য ভূ-প্রকৌশল প্রযুক্তি প্রয়োগের কথা চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বর্তমান সময়ের চেয়ে কমতে পারে; কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বের শতকোটিরও বেশি মানুষের স্বাস্থ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বৃদ্ধি পেতে পারে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিও।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
সৌর বিকিরণ ব্যবস্থাপনা (এসআরএম) ভূ-প্রকৌশল কিভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে, তা বোঝার জন্য এই গবেষণা করা হয়। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক গবেষকদলটি খুঁজে পেয়েছে যে ভূ-প্রকৌশল প্রযুক্তি ব্যবহার করলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষ ম্যালেরিয়াসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।
গবেষণার একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন গত বুধবার বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল ‘নেচার কমিউনিকেশনস’ প্রকাশ করেছে, যা ‘সোলার জিওইঞ্জিনিয়ারিং কুড রিডিস্ট্রিবিউট ম্যালেরিয়া রিস্ক ইন ডেভেলপমেন্ট কান্ট্রিজ’ বা ‘সৌর ভূ-প্রকৌশল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ম্যালেরিয়া ঝুঁকি পুনরায় বাড়াতে পারে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এ ধরনের সমীক্ষা ও মূল্যায়ন এই প্রথম।
এতে কিভাবে জলবায়ু সংক্রামক রোগের বোঝাকে প্রভাবিত করতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ সায়েন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির সহকারী গবেষণা অধ্যাপক কলিন কার্লসন এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন গবেষণার তথ্য প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জার্মানির আট গবেষক গবেষণাটি করেছেন। তারা বলছেন, ভেক্টর বাহিত রোগের ওপর জিওইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কৌশলগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে এটি প্রথম গবেষণা।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জিওইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে গ্রীষ্মমণ্ডলকে শীতল করা পর্যন্ত কিছু জায়গায় ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। এ ঝুঁকি ভবিষ্যতের পাশাপাশি বর্তমানের জন্যও উদ্বেগজনক। এতে মানুষ এবং বাস্তুতন্ত্রও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
তাই সোলার জিওইঞ্জিনিয়ারিং উন্নত বিশ্বের মানুষের সুরক্ষার বিষয় হলেও তাতে অন্যান্য দেশের জন্য ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা থাকা উচিত।
বিশেষ করে মশাবাহিত আপাত অবেহেলিত রোগের বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক রোধে জিওইঞ্জিনিয়ারিং একপাক্ষিক সমাধান। তবে স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবকে গুরুত্বের মধ্যে আনতে হবে।
সোলার জিওইঞ্জিনিয়ারিং উন্নত বিশ্বের মানুষের সুরক্ষার বিষয় হলেও তাতে অন্যান্য দেশের জন্য ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা থাকা উচিত।
গবেষণাটি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলো হ্রাস করার লক্ষ্যে অনুমানমূলক একটি পদক্ষেপ জরুরি। সূর্যালোক প্রতিফলিত করে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অ্যারোসল ইনজেকশনের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা সাময়িকভাবে থামিয়ে দেয়া যেতে পারে। তবে বিষয়টি স্বাস্থ্যের জন্য নেতিবাচক প্রভাবের কারণ হবে। জলবায়ু জিওইঞ্জিনিয়ারিং ম্যালেরিয়াসহ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচত প্রভাব ফেলবে।
প্রধান গবেষক কোলিন কার্লসন জানান, মানুষের জন্য একটি গ্রহে গরম থাকলে তা ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইটের জন্যও গরম হয়ে যায়। গ্রহকে শীতল করে জীবন বাঁচানো তাই বিকল্প বিষয় হতে পারে। তবে তাতে নেতিবাচক প্রভাবেরও শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ এবং ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘এটি প্রথম এ ধরনের গবেষণা, যা ভেক্টরবাহিত রোগের ওপর ভূ-প্রকৌশলগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব পরীক্ষা করে। ভূ-উষ্ণতা কমাতে যদি ভূ-প্রকৌশলের কৌশলগুলো প্রয়োগ করা হয় তাতে কিছু দেশ উপকৃত হবে এবং অন্যান্য দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ’
মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বিষয়টি এখনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো মনে হতে পারে; কিন্তু বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে সৌর বিকিরণ ব্যবস্থাপনায় ভূ-প্রকৌশল প্রয়োগের চিন্তা-ভাবনা চলছে। এটা বাস্তবতা। সে ধরনের ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করা হলে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর, বিশেষ করে ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়েই এই অনুমানমূলক গবেষণা।
এতে বাংলাদেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে—এ প্রশ্নের জবাবে শফিউল আলম বলেন, ‘উষ্ণতা কমলে আমাদের জন্য ভালো হবে বলেই মনে হয়। গবেষণায় আমরা যে ফলাফল পেয়েছি তাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিকে বর্তমান সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। দেশের ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। তবে আশঙ্কার দিকটি হচ্ছে আমাদের পাশের দেশ, বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার বাহক মশার প্রবেশ ঘটছে। ’
বলা হচ্ছে, এই গবেষণাটি সম্ভাব্য সৌর বিকিরণ ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিপজ্জনক প্রভাবগুলো হ্রাস করার লক্ষ্যে একটি অনুমানমূলক জরুরি হস্তক্ষেপ। গবেষকরা বলেছেন, সূর্যালোককে প্রতিফলিত করে বায়ুমণ্ডলে এর প্রভাব কামানো গেলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাময়িক বিরতি আনা যেতে পারে। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো নিয়ে খুব কম গবেষণা হচ্ছে।
গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জার্মানির আটজন গবেষক জলবায়ু মডেল ব্যবহার করে দুটি ভবিষ্যৎ পরিস্থিতিতে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ কেমন হতে পারে, তার উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করেন। এর একটি হচ্ছে মাঝারি বা উচ্চস্তরের বৈশ্বিক উষ্ণতার মধ্যে সম্ভাব্য সৌর বিকিরণ ব্যবস্থাপনায় ভূ-প্রকৌশল প্রয়োগের পরের পরিস্থিতি এবং ভূ-প্রকৌশল প্রয়োগ বাদে পরিস্থিতি। এতে শনাক্ত হয় কোন তাপমাত্রা অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে রোগ সংক্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী এবং সংক্রমণ সম্ভব, এমন এলাকায় কতজন লোক বাস করে।
দুই পরিস্থিতিতেই ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে স্থানান্তরিত হওয়ার এবং একই সঙ্গে ভূ-প্রকৌশল বিশ্বে ১০০ কোটির বেশি মানুষের ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি থাকার পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে অধ্যাপক কলিন কার্লসন বলেন, ‘গ্রহকে শীতল করা জীবন বাঁচানোর জন্য একটি জরুরি বিকল্প হতে পারে, তবে এতে বিপরীত ফলও পাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৪
আপনার মতামত জানানঃ