যুদ্ধের থেকে অনেকেই সরাসরি লাভ করে, যেমন অস্ত্র-ব্যবসায়ীরা, বা সেসব নির্মাণ কোম্পানি, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্নির্মাণের বরাত পাওয়ার আশা রাখে। এদের মধ্যে অনেকেই পৃথিবীর অতিবৃহৎ কোম্পানিগুলির মধ্যে পড়ে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চলে যুদ্ধ ও অশান্তির উপর—যত বেশি যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, মাফিয়ারাজ তত বেশি ব্যবসা। কারণ যাই হোক, এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, অনেকেই চাইছে এই যুদ্ধটা চলুক।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ৫০তম দিন পার হতে চলেছে। এই সংঘাত ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। বিশ্বের জন্য এটি হৃদয় বিদারক হলেও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্য এটি অত্যন্ত লাভজনক বিষয়।
বিপুল শক্তিধর রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য ইউক্রেনকে বিবিধ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিমা মিত্র দেশরা। কিয়েভ যত বেশি সাহায্য হিসেবে বিদেশি অস্ত্র পাচ্ছে, মস্কো তার সাথে পাল্লা দিয়ে হামলার তেজ বাড়াচ্ছে। এর ফলে দিনে দিনে যুদ্ধ আরো রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। একই সাথে যুদ্ধ আরো দীর্ঘ হচ্ছে। বিশ্ব কাঁদলেও এর সুফল ভোগ করছেন অস্ত্র ব্যবসায়ীর।
যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মানুষের জনজীবনে যেমন দুর্দশা নেমেছে তেমনি বিশ্ব জুড়ে তেলসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে কয়েকগুণ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষেরা পথে বসতে শুরু করেছেন। কিন্তু এর মধ্যে ফুলেফেঁপে উঠছে দুনিয়ার তাবড় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা।
সাধারণত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সরকার অস্ত্র তৈরি করে না। ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠান অস্ত্র তৈরি করে থাকে। তারা যখন অন্য কোনো দেশকে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন কেবল অস্ত্র তৈরি ওই প্রতিষ্ঠানেরই মুনাফা হয়।
যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী প্রভাব, গোটা বিশ্ব জুড়ে মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছোঁয়ার দশা, গরিব মানুষের আরও গরিব, মধ্যবিত্তের প্রান্তিক হওয়ার প্রক্রিয়া তেল দেওয়া মেশিনের মতো এগোচ্ছে দিগন্তের পথে। হাজারো ধ্বংসের মধ্যেও ফুলেফেঁপে উঠছে দুনিয়ার তাবড় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। সাধারণত, আমেরিকা-সহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে অস্ত্র তৈরি পুরোপুরি বেসরকারি হাতে। তারা যখন অন্য কোনও দেশকে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন আখেরে লাভ হয় সেই অস্ত্র তৈরি সংস্থাগুলিরই।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনের উপর বিশেষ সামরিক অভিযানের নামে হামলা চালায়। হামলার ৫০ দিন পেরিয়ে গেলেও সংঘাত থামার কোনো লক্ষণ নেই। এর মধ্যে একা যুক্তরাষ্ট্রই এখন পর্যন্ত ২৪০ কোটি ডলারের অস্ত্রশস্ত্র কিয়েভের হাতে তুলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিয়েছে ১৬৩ কোটি ডলারের অস্ত্র। এছাড়াও আরো অন্তত ৩০টি দেশ থেকে ইউক্রেনে অস্ত্র ঢুকছে। এতে করে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আয় হয়েছে কোটি কোটি ডলার।
বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় অস্ত্রশস্ত্রের বিক্রেতা। দ্বিতীয় স্থানে রাশিয়া। যদিও তা যুক্তরাষ্ট্রের এক তৃতীয়াংশও নয়। বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেওয়া একটি সিদ্ধান্তের কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ৫০তম দিন পার হতে চলেছে। এই সংঘাত ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। বিশ্বের জন্য এটি হৃদয় বিদারক হলেও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্য এটি অত্যন্ত লাভজনক বিষয়।
ওই বছর বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র প্রস্তুতকারক ‘লকহিড মার্টিন’–এর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ট্রাম্প সরকার কিয়েভের হাতে জ্যাভেলিন অ্যান্টি ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র তুলে দিয়েছে। সেই সময়ই পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, এর পরিণতি ভাল হবে না। তারপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়। তার প্রভাব এসে পড়েছে করোনা বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে। কিন্তু সব হারানোর যুদ্ধে, লাভের কড়ি গুনছে সেই অস্ত্র ব্যবসায়ীরাই।
যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। করোনা মহামারির কারণে লকডাউন, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্কসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব থাকার পরেও বিশ্বে অস্ত্র বিক্রির ধুম ছিল।
ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযানের পর সামরিক শক্তি বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। সামরিক ব্যয় বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। তালিকায় রয়েছে ডেনমার্ক ও সুইডেনও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে ইউরোপে অস্ত্র আমদানিতে রেকর্ড হয়েছে।
সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আগের পাঁচ বছরের তুলনায় ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বে অস্ত্র রপ্তানি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। তবে বিপরীত চিত্র ইউরোপে। সেখানে অস্ত্র আমদানি ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
এসআইপিআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক সিমন ওয়েজম্যান বলছেন, ‘ইউরোপ অস্ত্রের নতুন হটস্পটে পরিণত হয়েছে। আমরা সামরিক ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়াচ্ছি। আমাদের নতুন অস্ত্র দরকার। এর বেশির ভাগই আমদানি করা হবে।’
এই অস্ত্রের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্য দেশগুলো থেকে আমদানি করা হবে বলে মনে করছেন ওয়েজম্যান। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বৈশ্বিক অস্ত্রবাণিজ্যে ইউরোপের অংশ ১০ থেকে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। ভবিষ্যতেও তা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকবে।
অস্ত্র কেনাবেচার অনেক চুক্তিতে অস্বচ্ছতা রাখা হয়। সহায়তা হিসেবে অস্ত্র সরবরাহ করলে সেখানে কোনো আর্থিক লেনদেন থাকে না। ফলে অস্ত্রবাণিজ্যের সঠিক চিত্র বের করা বেশ জটিল হয়ে পড়ে। এরপরও বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রি হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
বিশ্লেষকরা বলেন, যুদ্ধ হয় কেন? যে কোনও যুদ্ধের নিরিখে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এসব বিষয়ের পণ্ডিতদের এই প্রশ্ন করলে তারা সেই যুদ্ধের কারণ গভীরে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তুলনায় আমাদের প্রশ্নটা সাধারণ অর্থে করা, এবং এটি একটি বিশেষ যুদ্ধ নিয়ে নয়। সাধারণ মানুষকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে পাণ্ডিত্যের আবরণ সরিয়ে রেখে, কেবল সরল এবং সবল মানবতার দৃষ্টিতে। সাধারণভাবে আমরা সবাই যুদ্ধর হৃদয়বিদারক ছবি দেখে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ এবং বিষণ্ণ। সবাই চাইছি এই যুদ্ধের সমাপ্তি। বস্তুত, আমরা প্রায় কাউকেই চিনি না যে অন্যকে মেরে, তার সম্পত্তি দখল করে, ব্যক্তিগতভাবে ধনী হতে চায়। অর্থাৎ প্রায় কেউই যুদ্ধ চায় না, যদি না তা একান্ত আক্রান্ত মানুষের বাঁচার লড়াই হয়। সবাই খোঁজে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, কাজের সুযোগ এবং শান্তিপূর্ণ জীবন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বারবার এই পৃথিবীতে যুদ্ধ হয়। তাহলে কে যুদ্ধ ও ধ্বংস চায়, কার স্বার্থে যুদ্ধ হয়?
তারা বলেন, যুদ্ধ হয় শাসকশ্রেণির ইচ্ছায়, সম্পদ দখল ও ক্ষমতাবিস্তারের লোভে, ব্যক্তিগত গরিমার আকাঙ্ক্ষায়। আর এই যুদ্ধে সর্বাধিক মূল্য দেয় সেসব অগুনতি সাধারণ মানুষ– কখনও যুদ্ধের সেনা হয়ে, কখনও সাধারণ নাগরিক হিসাবে। এরা কেউ যুদ্ধ চায়নি। তাদেরই জীবনের মূল্যে লাভবান হয় শাসকশ্রেণি, যারা একইসঙ্গে ক্ষমতা এবং সম্পদের বিপুল অংশ ভোগ করে। মজার কথা হল, প্রতিটি যুদ্ধের আগেই শাসকশ্রেণির প্রয়োজন হয় তার সাধারণভাবে শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের কিছু একটা বুঝিয়ে পক্ষে নিয়ে আসা। তার জন্য তারা কখনও ব্যবহার করে উগ্র জাতীয়তাবাদ, কখনও ধর্মীয় জিগির, কখনও অন্য দেশ আর সেখানকার মানুষ সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার। আর, আমরা অনেকেই এসব প্রচারে প্রভাবিত হয়ে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, শাসকের ফন্দিতে সম্মতি জানাই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা হাজির হয়ে শান্তির কথা বলেন৷ অস্ত্র নয়, মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কথা বলেন৷ কিন্তু তাদের কথায় এবং কাজে যে বিস্তর ফারাক, আন্তর্জাতিক শান্তি সংস্থাটির রিপোর্ট তা চোখে আঙুল দেখিয়ে দিল৷ তাদের রিপোর্টে যার উল্লেখ নেই, ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও কোনও রিপোর্টে সে সত্যও এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে৷ কেবল পশ্চিম দুনিয়া নয়, পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে উপমহাদেশের দেশগুলি৷ গত কয়েক বছরে সামরিক খাতে তাদের বরাদ্দও বেড়েছে চোখে পড়ার মতো৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এভাবে অস্ত্র ব্যবসা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে আরও বড় অশান্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৮
আপনার মতামত জানানঃ