চলতি বছরের পবিত্র রমজান মাসেও ইসরায়েল–অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। ইসরায়েলের অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে দেশটির পুলিশ ও ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের হামলায় ১৫২ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। এ ছাড়া কয়েক শ ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে পুলিশ। খবর আল-জাজিরার।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর পরিপ্রক্ষিতে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা গত বছরের রমজানের মতোই আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন।
পবিত্র রমজান মাস চলার মধ্যেই আল-আকসায় ইসরায়েলি পুলিশের অভিযানকে কেন্দ্র করে গতকাল শুক্রবার(১৫ এপ্রিল) সকালে এ সংঘর্ষ বাধে। আরব নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভোরের দিকে ইসরায়েলি পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৩ জন প্যারামেডিক, ৩ জন সাংবাদিকসহ ৪০০ ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে।
ফিলিস্তিনি সূত্র জানায়, ইসরায়েলি পুলিশ মসজিদের সব দরজা বন্ধ করে দেয়। সেখানে রেড ক্রিসেন্টের সদস্যদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয় এবং আহতদের মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে হাসপাতালে নিতে আসা অ্যাম্বুলেন্সকে আটকে দেওয়া হয়।
পুলিশ আল-আকসার প্রহরী, প্রেস, মেডিকেল স্টাফ এবং রেড ক্রিসেন্টের চিকিৎসকের দিকে রাবার বুলেট এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের লাঠি দিয়ে আঘাত করে বলেও অভিযোগ করা হয়।
এ ছাড়াও, ইসরায়েলি পুলিশের বিরুদ্ধে অ্যাম্বুলেন্সের চাবি কেড়ে নেওয়া এবং আল-আকসা ক্লিনিককে ঘিরে ফেলার অভিযোগ করা হয়েছে। সেখানে কয়েক ডজন আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল বলে ফিলিস্তিনিদের দাবি।
মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। আর ইহুদিদের কাছে এটি খ্যাত টেম্পল মাউন্ট নামে। তারাও এটিকে তাদের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে ইসরায়েলি পুলিশের দাবি, আল–আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে পাথর ছুড়ছিলেন একদল বিক্ষোভকারী। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে সেখানে প্রবেশ করে পুলিশ। আটক করা হয় ৩০০ জনকে। তবে ফিলিস্তিনি সূত্র বলছে, ৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে আটক করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মসজিদ প্রাঙ্গনে উপস্থিত ব্যক্তিদের নির্মমভাবে মারধর করা হয়। এই অভিযানের ফলে, ইসরায়েলি পুলিশ এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে শত শত ফিলিস্তিনি তরুণের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট ছুড়েছে। বিক্ষোভকারীরাও ইসরায়েলি বাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়েন।
আরব নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল-আকসার সমর্থনে এবং ইহুদিদের পাসওভারের সময় মসজিদে ইসরায়েলিদের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সতর্কতা হিসেবে ভোরের নামাজের পরে একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সময় ফিলিস্তিনি তরুণরা ইসরায়েলি পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ও আতশবাজি নিক্ষেপ করে।
সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, শুক্রবারের নামাজের কিছুক্ষণ আগে আল-আকসার দরজা খুলে দেওয়া হয়। তখন ইসরায়েলি বাহিনী আল-আকসা আঙ্গিনা থেকে শত শত ফিলিস্তিনি যুবককে গ্রেপ্তার ও বের করে দেয়। সকালের সহিংসতার ফলে যারা জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদে রমজানের দ্বিতীয় জুমার নামাজ আদায় করতে যান তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
আল-আকসা মসজিদের পরিচালক শেখ ওমর আল-কিসওয়ানি আরব নিউজকে বলেন, ইসরায়েলি পুলিশ মসজিদে হামলা এবং শুক্রবার ভোরের দিকে সহিংস দমনের ফলে সেখানে আসা মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। এখানে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ ছিলেন এবং আমরা আশা করেছিলাম এই সংখ্যা ১ লাভ ৭০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি অভিযোগ করেন, ইসরাইল ধারাবাহিকভাবে আল-আকসা মসজিদের আইন লঙ্ঘন করছে এবং মুসলমানদের উসকানি দিচ্ছে। ইসরায়েলিরা এই সংঘাতকে একটি ধর্মীয় সংঘাতে পরিণত করতে চায় এবং মসজিদের ওপর একটি নতুন নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিতে চায়।
ইসরায়েলি পুলিশের জারি করা এক বিবৃতিতে দাঙ্গা ও জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার জন্য ফিলিস্তিনিদের দায়ী করা হয়েছে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে আরব স্ট্রিটে কয়েকটি মারাত্মক হামলার পর ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। এর মধ্যে পবিত্র মসজিদ আল-আকসার প্রাঙ্গণে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল।
ইসরায়েলের পুলিশ এক বিবৃতিতে বলেছে, শুক্রবার ভোরে নামাজের পর শত শত ফিলিস্তিনি আল-আকসার নিকটবর্তী ইহুদিদের প্রার্থনাস্থান লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল, পাথর ছুড়তে শুরু করে। ওই জায়গায় আগে থেকেই ইসরায়েলের পুলিশ বাহিনী অবস্থান করছিল। পুলিশ বাহিনী তখন আল-আকসা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এবং মুসল্লিদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এ সময় সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং তিনজন ইসরায়েলি পুলিশ আহত হন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের মুখপাত্র এক টুইটে বলেছেন, ‘পুলিশ কয়েক শ ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে।’
নাফতালি বেনেট বলেছেন, ‘আমরা আল-আকসা এবং সমগ্র ইসরায়েলে শান্তি পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করছি। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী যেকোনো অবস্থা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছে।’
ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আল-আকসার সহিংসতার কথা উল্লেখ করে বলেছে, ‘এই সহিসংতার জন্য ইসরায়েল সরাসরি দায়ী।’
এদিকে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইন বলেছেন, ‘আল-আকসায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করতে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া রোধ করতে অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
ইসরাইল ধারাবাহিকভাবে আল-আকসা মসজিদের আইন লঙ্ঘন করছে এবং মুসলমানদের উসকানি দিচ্ছে। ইসরায়েলিরা এই সংঘাতকে একটি ধর্মীয় সংঘাতে পরিণত করতে চায় এবং মসজিদের ওপর একটি নতুন নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিতে চায়।
এদিকে গাজা উপত্যকায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শুক্রবার জুমার নামাজের পর আল-আকসায় ইসরাইলি পুলিশের হামলার নিন্দা জানিয়ে গণসমাবেশে অংশ নেয়।
মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ সমন্বয়ক টর ওয়েনল্যান্ড ‘জেরুজালেমের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি’ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, পবিত্র এসপ্ল্যানেডের ওপর উসকানি এখনই বন্ধ করতে হবে।
তিনি অবিলম্বে আল-আকসায় উসকানি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতি শান্ত করতে জাতিসংঘ প্রধান আঞ্চলিক অংশীদার এবং পক্ষগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। তিনি উভয়পক্ষের কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইসরায়েলি পুলিশের এমন কর্মকাণ্ডে নিন্দা জানিয়েছে জর্ডান। তারা আল-আকসা মসজিদ ও সেখানে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র গতকাল শুক্রবার বলেছে, তারা এ সহিংসতায় ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা সব পক্ষকে সংযম দেখানোর এবং উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য এড়াতে আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের উত্তেজনা কমাতে এবং সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পবিত্র রমজান মাস এলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে ইসরায়েল। চলতি বছরের পবিত্র রমজান মাসেও ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর পরিপ্রক্ষিতে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা গত বছরের রমজানের মতোই আরেকটি যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।
জেরুজালেমভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাজেন জাবারি আল-জাজিরাকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে তা বড় ধরনের বিস্ফোরণের জন্য উপযুক্ত।
গত বছর জেরুজালেমে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করাকে কেন্দ্র করে জনক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। ফিলিস্তিনিদের ওই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনজুড়ে।
এ বছরের মতো ঠিক গতবারও আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রবেশ ও অভিযান আগে থেকেই চলে আসা দুই পক্ষের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ওই অভিযানের চার দিন পর গাজায় টানা ১১ দিন স্থল ও বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় কয়েক শ মানুষ হতাহত হন। নিহত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ ছিল শিশু। হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গাজার বাড়িঘরসহ বহু স্থাপনা। বাদ পড়েনি হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ঘটনা নিয়ে ইসরায়েল বলেছিল, হামাসের রকেট ছোড়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা গাজায় অভিযান চালিয়েছে মাত্র।
গত রমজানের সংঘর্ষের পর সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা এবার ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের আরেকটি লড়াইয়ের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাজেন জাবারি বলেন, এবারের সংঘর্ষ শুধু যে জেরুজালেমের দিক থেকে শুরু হতে পারে তা নয়, বিভিন্ন দিক থেকেই শুরু হতে পারে। যেমন জেনিনে (পশ্চিম তীরের শহর) বিস্তর সংঘর্ষ হতে পারে। কারণ ইসরায়েল ওই শহরে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানে নামার কথা বলতে পারে তারা।
গত ২২ মার্চ থেকে ইসরায়েলের ভেতরে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের হামলা বা ‘সশস্ত্র অপারেশন’ বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন ইসরায়েলি তিন পুলিশ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৩৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এমনটাই জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জেনিনে দুজন নিহত হন। সে সময় ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের তেল আবিব ও বেনি বারেক শহরের কাছে হামলা চালান। আগের দিন বুধবার পশ্চিম তীরে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর ও এক আইনজীবীকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী।
জেনিনের শরণার্থীশিবিরে বড় ধরনের ইসরায়েলি আক্রমণের আশঙ্কা বাড়ছে। কারণ, সেখানে প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) ও ফাতাহ আন্দোলনের সশস্ত্র শাখার সদস্যরা সক্রিয়।
সংঘর্ষ শুরুর আভাস আসছে পিআইজের দিক থেকেও। ১০ এপ্রিল এই গ্রুপের এক মুখপাত্র হুঁশিয়ারি দেন, যদি ইসরায়েলি বাহিনী জেনিনের শরণার্থীশিবিরে আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তবে খুব শিগগির তাদের দিক থেকেও চূড়ান্ত জবাব আসবে।
গাজার শাসনক্ষমতায় থাকা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আবার লড়াইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, যদি ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা আল-আকসা মসজিদ নিয়ে তাদের অসহিষ্ণু আচরণ দেখিয়ে যেতে থাকেন, তবে হামাস বসে থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৮
আপনার মতামত জানানঃ