ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। গতকাল সোমবার মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে ব্লিংকেন এ কথা বলেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ভারতের সরকার, পুলিশ ও কারাগারের কর্মকর্তাদের করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্রমবর্ধমান ঘটনাসহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার ওপর নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র।
ব্লিঙ্কেন এসময় বলেন, ‘আমরা নিয়মিত আমাদের ভারতীয় অংশীদারদের সঙ্গে অভিন্ন মূল্যবোধ (মানবাধিকার বিষয়ক) নিয়ে যোগাযোগের মধ্যে থাকি। আর তার অংশ হিসেবে আমরা সাম্প্রতিক কিছু উদ্বেগজনক ঘটনা লক্ষ্য করছি। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের কিছু সরকারি, পুলিশ এবং কারাগারের কর্মকর্তার দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি।’
যদিও ব্লিংকেন এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি। এদিকে সিং ও জয়শঙ্কর এই ব্রিফিংয়ে ব্লিংকেনের পরে বক্তব্য রাখলেও মানবাধিকার ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করেননি।
মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ইলহান ওমর গত সপ্তাহে অভিযোগ করেন, মানবাধিকার বিষয়ে ভারত সরকারের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারের অনিচ্ছা রয়েছে। এই প্রশ্ন তোলার কয়েক দিন পরেই ব্লিংকেন এই মন্তব্য করলেন।
ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মোদি আর কী করলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বিশ্বশান্তির অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা বন্ধ করবে বলে প্রশ্ন তোলেন ওমর। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য ওমর।
উল্লেখ্য, বিগত কয়েক মাস ধরে কর্ণাটকে হিজাব থেকে শুরু করে হালাল মাংস নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। সম্প্রতি আবার মন্দিরের বাইরে মুসলিমদের দোকান নিয়েও ঝামেলা শুরু হয়েছে। বিজেপি এই সব ঝামেলার সাথে সরাসরি জড়িত না থাকলেও ডানপন্থী সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডে বিজেপির ‘সমর্থন’ নিয়ে সরব বিরোধীরা।
এই আবহে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমেরিকার মতো পার্টনারের কাছে এই বিষয়ে শুনতে হল মোদি সরকারকে। যদিও কূটনৈতিক কারণে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি কিছু বলেননি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত বছর ভারতের আসামে সরকারি বাহিনী কর্তৃক মুসলমানদের উচ্ছেদ ও তাদের নির্যাতনের একটি চিত্র উঠে এসেছে মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে
বেশ কয়েকটি ভারতীয় রাজ্য ধর্মান্তরবিরোধী আইন পাস করেছে। এটি বিশ্বাসের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে।
২০১৯ সালে ভারত সরকার একটি নাগরিকত্ব আইন পাস করে। সমালোচকদের মতে, এই আইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে মুসলিম অভিবাসীদের বাদ দিয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
২০১৫ সালের আগে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দু, জৈন, পারসি ও শিখদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের উদ্দেশ্যে ছিল এই আইন। ওই বছরই মোদি সরকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে। এছাড়া সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যে শ্রেণিকক্ষে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সত্ত্বেও, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ‘নিয়মিতভাবে’ সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ঘটনাগুলো কদাচিৎ স্বীকার করে।
মোদির প্রথম ক্ষমতায় থাকাকালীন বিবিসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, গরুর মাংস খেয়েছে, অথবা তারা গরু পাচারের চেষ্টা করছে এমন গুজব ছড়িয়ে তথাকথিত ‘গরু রক্ষীদের’ দ্বারা মুসলিম নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে।
প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের হামলাকে সমর্থন করেননি, কিন্তু দ্রুত বা কঠোরভাবে তাদের নিন্দা না করার জন্য সমালোচিত হন। ২০১৯ সালে, ভারতে ‘ঘৃণা অপরাধ’ গণনা করা একটি ফ্যাক্ট-চেকার ওয়েবসাইট জানিয়েছে যে, গত ১০ বছরে নির্যাতনের শিকার হওয়াদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মুসলিম।
এবং এই হামলার ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়না। অভিযোগ রয়েছে যে, তারা মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করছে। এর আগে মোদির একজন মন্ত্রী একজন মুসলিমকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত আটজন হিন্দুকে মালা দিয়েছিলেন।
গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অধোগতির জন্য নরেন্দ্র মোদী এবং তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির সরকার দায়ী প্রশ্নাতীতভাবেই। ‘সিভিকাস পিপল পাওয়ার আন্ডার অ্যাটাক ২০২১’ প্রতিবেদনে ভারতের সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন, যেমন দমনমূলক বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন (ইউএপিএ) মোদি সরকার পরিকল্পিতভাবে অপব্যবহার করছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সময়ে কয়েক ডজন মানবাধিকার কর্মীকে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে এবং তাদের জামিনের ব্যাপারে কোনো সাহায্য করা হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্থাটির রিপোর্টে ২০১৮-র ভীমা কোরেগাঁও- এলগার প্রসাদ জাতি হিংসার মামলায় সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজকে আটকে রাখার প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করা হয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরে মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের বাড়িতে অভিযান এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে। এমনকি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের দমানোর জন্য সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করা হয়েছে রিপোর্টে।
সাংবাদিকদের উপর পুলিশের অত্যাচার, রাজনৈতিক নেতাদের চাপ সৃষ্টি, দুর্নীতিবাজ অফিসার ও অপরাধমূলক গোষ্ঠীর প্রতিশোধের হুমকি; সব মিলিয়ে ভারতের খর্ব হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা৷
দ্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের এক রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, হিন্দুবাদী সরকারের লাইনে থাকতে সংবাদমাধ্যমগুলির উপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে৷ যে সব সাংবাদিকরা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বা কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লিখছেন বা মুখ খুলছেন, তাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে চরম হেনস্থা, হুমকি দেওয়া হচ্ছে৷ বিশেষ করে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন মহিলা সাংবাদিকরা৷
এদিকে, ফ্রিডম হাউস বলছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নাগরিক স্বাধীনতার অবনতি হচ্ছে। তারা আরো বলেছে যে “মুক্ত রাষ্ট্রের উচ্চ কাতার থেকে ভারতের এই পতন” বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
মোদীর শাসনকালে “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে ভারত এখন পাকিস্তানের মতই স্বৈরাচারী, এবং বাংলাদেশ ও নেপালের চাইতেও সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ। কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ায় এবং নাগরিক অধিকারের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ হওয়ায় ভারতের এই অবনতি হয়েছে। মোদীর বিভিন্ন নীতিসমূহ ভারতে মুসলিম-বিরোধী অনুভূতি এবং ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিয়েছে, এবং তা ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সিভিকাস দেশগুলোকে পাঁচটি বিভাগে ভাগ করেছে, যেখানে ‘উন্মুক্ত’ দেশগুলোর জনগণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা উপভোগ করছে এবং ‘নিপীড়িত’ দেশের বাসিন্দারা কঠোর বিধিনিষেধের সম্মুখীন হয়েছেন। ভারত ছাড়াও ‘নিপীড়িত’ স্থান পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে– বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং আফগানিস্তান। সরকারের কাছে মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছে এ রিপোর্টে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ