নুর নবী দুলাল, হামবুর্গ
বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থার কেন্দ্র এখন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দেশটির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত চাপ, সামরিক-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি, ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, এরকম আরো অনেক কারণে কিছু প্রভাবশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে তাদের ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র জন্য হুমকি মনে করছে। চীন, রাশিয়া ও ইরান এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ও সোচ্চার। পৃথক ইন্টারনেট ব্যবস্থা গত এক দশকে এসব দেশের প্রধান অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছে।
রাশিয়ার দাবি, লক্ষ্যের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তারা। ইরান এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ করেছে বলে জানিয়েছে। চীন অবশ্য এ নিয়ে চুপচাপ। তবে অন্যদের ধারণা, ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিভক্ত করার মূল কারিগর শি জিনপিংয়ের দেশই। কিন্তু কেন এই বিভক্তি তা প্রতিটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পরিষ্কারভাবে জানা দরকার। কেবল এর মাধ্যমেই উপলব্ধি করা সম্ভব যে, এই বিভক্তি ঘটতে আর কত বাকি? কিভাবে সম্পন্ন হতে পারে এই মহাবিভক্তি? এটা কি আদৌ সম্ভব? জনগণের ওপর এর কী প্রভাব পড়বে? বিশ্বের বিদ্যমান শাসকরা কি পারবে এই বিভক্তি ঠেকাতে?
ইন্টারনেট বিভক্তির কারণ
চীন : প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা চীন ও পরাশক্তি রাশিয়ার প্রবল দ্বন্দ্বের কথা কারো অজানা নয়। সাম্প্রতিক চিত্র হলো, উভয় দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা আগের চেয়ে বেশি কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। চীনের সঙ্গে যদিও যুক্তরাষ্ট্রের একার দ্বন্দ্ব, তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের নেতারা ভয়াবহ রকমের কঠোর। অথচ চীন ও রাশিয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রমাগত একে অপরের নিকটবর্তী হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে থাকা ক্ষমতাধর আরেক রাষ্ট্র ইরান। এই দেশগুলো উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইন্টারনেটের ওপর দখল রাখতে চাইছে।
চীনের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ইন্টারনেটনির্ভর। ইন্টারনেটে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দাদাগিরি’ চীনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করা হচ্ছে। চীন এ মুহূর্তে বিশ্ববাণিজ্যকেই পাখির চোখ করেছে। সে লক্ষ্যে তারা গ্রহণ করেছে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। এই কর্মসূচি দিয়ে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজস্ব সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে সুবিধা করতে হলে সেখানে ইন্টারনেটকেই ভিত্তি করতে হবে। কিন্তু হুয়াওয়েসহ বড় কিছু চীনা প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ বা নজরদারির মধ্যে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সরকার সে দেশের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। তাই তারা ইন্টারনেট নিরাপত্তায় ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।
চীন অবশ্য ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণে আগে থেকেই সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ। ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা তাদের নতুন নয়। ‘দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল অব চায়না’ নামে পরিচিত চীনের রয়েছে নিজস্ব এক পরিশোধন ব্যবস্থাপনা। যা সে দেশে ঢোকা প্রতিটি সাবমেরিন কেবলের ওপর নজরদারি করছে এবং চাইলেই তারা যেকোনো সময় বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। এই ব্যবস্থা দিয়ে চীনা জনগণের মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে বটে! তবে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় ছোট-বড় সব উদ্যোক্তাদের ভরসা হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। কম্পানির কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ইন্টারনেটের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। এর ফলে চীনে শত কোটি ডলার মূল্যের একাধিক প্রতিষ্ঠানসহ ইন্টারনেটভিত্তিক লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান গড় উঠেছে। চীনের বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কিন যেকোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টেক্কা দেয়ার সক্ষমতাও অর্জন করেছে।
কিন্তু ইন্টারনেটের নিরাপত্তা ছাড়া এর কোনো কিছুই টেকসই নয়। ফলে হুয়াওয়ের ওপর আক্রমণ বা চীনা কম্পানিকে যন্ত্রাংশ বিক্রিতে বাধা দেয়া কিংবা চীনা কম্পানির বিদেশে উপস্থিতি ও ব্যবসা বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার একটাই বিকল্প দেখছে শি জিনপিংয়ের সরকার। আর সেটা হলো ইন্টারনেটে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমান খণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে তারা আর নিরাপদ ভাবছে না।
রাশিয়া : ২০১১ থেকে ২০১২ সালে রাশিয়ায় ‘উইন্টার অব প্রোটেস্ট’ শীর্ষক এক আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম তথা ইন্টারনেটের ভূমিকা ছিল। এ সময় রাশিয়ার নাগরিকদের ওপর ‘বিকৃত প্রভাব’ বিস্তার করা থেকে পশ্চিমাদের বিরত থাকার আহবান জানায় মস্কো। আন্দোলনের পরে ইন্টারনেটে চীনের মতো ডিজিটাল সীমান্ত গড়ার কথা ভাবতে শুরু করে রাশিয়া। তবে চীনের দেখানো পদ্ধতিতে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করাটা রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না। চীনের নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি সাধারণত ইন্টারনেটের কনটেন্টভিত্তিক (শব্দ, লেখা, ভিডিও, অডিও) নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। চীন শুরু থেকেই ইন্টারনেট কেবলের সংযোগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই পদ্ধতি রাশিয়াতে কাজ করত না। কারণ রাশিয়া নিজেও জানে না কতটি এবং কতভাবে তারা বৈশ্বিক ইন্টারনেটে যুক্ত।
এই সীমাবদ্ধতাই রাশিয়াকে উদ্বুদ্ধ করে নিজস্ব ইন্টারনেট গড়ে তুলতে। দেশটি দীর্ঘদিন ধরে নিজ দেশে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ আছে, সাইবার আক্রমণ পরিচালনা এবং ইন্টারনেটে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেয়াসহ ইন্টারনেট প্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহারের পথ নিয়েও সরকারিভাবে কাজ করছে রাশিয়া। ২০১৬ সালের এক আইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে ব্যবহারকারীদের তথ্য রাশিয়ার অভ্যন্তরে স্থাপন করা সার্ভারে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। ওই উদ্যোগের আওতায় রুশ সরকার সব ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে এমন প্রযুক্তি বসাতে বলেছে যেন কর্তৃপক্ষ চাওয়া মাত্র তথ্যের আদানপ্রদান বন্ধ করে দিতে পারে। তখন ওসব পদক্ষেপকে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার ব্যবস্থা হিসেবে দেখানো হয়েছিল।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সই করা নতুন একটি আইন ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস থেকে রাশিয়ায় কার্যকর হয়েছে। এই নতুন আইনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের না জানিয়ে কনটেন্ট ব্লক করে দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। এ আইনের বলে বৈশ্বিক ইন্টারনেট সংযোগ থেকে রাশিয়াকে যখন তখন পুরো বিচ্ছিন্ন করে দেয়াও সম্ভব। সরকার বলছে, সংকট কিংবা বাইরের হামলার সময়ও যেন রাশিয়ার ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করে, সেই লক্ষ্যে এই আইন করা হয়েছে। আইনের খসড়া প্রস্তুতকারীদের একজন আন্দ্রেই ক্লিশাস বলেন, আমরা যদি দেখি অন্য কারো আমাদের ওপর আক্রমণ করার সামর্থ্য আছে, তাহলে আমাদেরও তা প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকা উচিত। আমাদের কোনো সন্দেহ নেই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজন মনে করলেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারে। আইনের মধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তার ওপর মার্কিন আগ্রাসী চরিত্রের প্রভাব ঠেকাতেই এর প্রয়োজন। ২০১৮ সালের একটি মার্কিন প্রতিবেদনে রাশিয়াকে দেশটির কৌশলগত প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে সেখানে।
ইরান : ২০১৯ সালের নভেম্বরে ইরানে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা জানতেন, ইরানের ইন্টারনেট কোনো একক কেবল নির্ভর নয়। এ ধরনের ইন্টারনেট ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করা বেশ কঠিন। গ্রাহকদের মধ্যে যারা প্রযুক্তি বিষয়ে কিছু জ্ঞান রাখেন, তারা এরকম ব্যবস্থার ফাঁক গলে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারেন। কিন্তু ইরানে সেটা ঘটেনি। সরকারের চাওয়া মতো দ্রুতই বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট। কিন্তু এর মধ্যেও দেখা গেল সরকারি কাজকর্মে ঠিকই ইন্টারনেট চলছে।
ওই ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সময় জানা যায়, অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক তৈরির পেছনে বেশ কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ করেছে ইরান। নির্ধারিত কিছু সরকারি দপ্তর ও ব্যাংকে তারা বিকল্প সংযোগ দিয়েছে। এতে করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও দেশের ভেতরে ‘অনলাইনে’ থাকার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর। যেসব ওয়েবসাইট ওই নেটওয়ার্কে সংযুক্ত, শুধু সেগুলোতে প্রবেশাধিকার পাওয়া যাচ্ছে। ইরান সরকারের নিজস্ব অ্যাপসগুলো তখনো সক্রিয় ছিল এবং ওয়েবসাইটে তা কাজও করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোনো কনটেন্টের প্রবেশাধিকার পাওয়ার মতো নেটওয়ার্ক সংযোগও পাওয়া যাচ্ছিল না। ইরান তখন ঘোষণা দিয়েছিল, ‘নিজস্ব ইন্টারনেট’ ব্যবস্থা গড়ার অংশ হিসেবে তারা ‘জাতীয় তথ্য নেটওয়ার্ক’ প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ করেছে।
কীভাবে বিভক্তি সম্পন্ন হতে পারে?
ইন্টারনেট ব্যবস্থার বিভক্তিকে ইংরেজি ভাষায় ‘স্প্লিন্টারনেট’ বা দ্বিখণ্ডিত ইন্টারনেট বলে ডাকা হচ্ছে। রাশিয়ার পরিকল্পনা হলো, ২০২১ সাল থেকে সে দেশে একটি স্বাধীন ‘ডোমেন নেম সিস্টেম’ বা ডিএনএস ব্যবস্থা চালু হবে। ডিএনএস হলো ওয়েবসাইটের নামের পেছনে যে আইপি অ্যাড্রেস থাকে তার পাঠযোগ্য করার ব্যবস্থা। অর্থাৎ আমরা কোনো একটি ওয়েবসাইটের নাম (যেমন স্টেটওয়াচ ডটনেট) লিখলে ডিএনএস ব্যবস্থার কল্যাণে সেই ওয়েবসাইট যে আইপি অ্যাড্রেসে সংযুক্ত, ইন্টারনেট আমাদের সেখানে নিয়ে যায়। রাশিয়া বর্তমান ডিএনএস ব্যবস্থার (বর্তমান সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে) একটি নিজস্ব কপি তৈরি করেছে। এই প্রকল্প সফল হলে রাশিয়ার আর সেন্সরশিপের প্রয়োজন হবে না। এমনকি রাশিয়ার ইন্টারনেট ট্রাফিক কখনোই বাইরে যাবে না। নাগরিকেরা দেশটির বাইরের কোনো তথ্যভান্ডারেও প্রবেশের সুযোগ পাবেন না, যদি সে দেশের সরকার সুযোগ না দেয়। এমনকি কোনো ‘ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক’ অথবা ‘টর প্রজেক্টের’ মাধ্যমেও বিকল্প নেটওয়ার্ক তৈরি করে বৈশ্বিক ইন্টারনেটে প্রবেশ করা যাবে না।
রাশিয়ার নিজস্ব ডিএনএস-এর মানে হচ্ছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যখন কোনো ওয়েবসাইটের ঠিকানা লিখবেন, তখন আসলেই যে কোন ওয়েবসাইট খুলবে, তার নিয়ন্ত্রণ আর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবস্থার হাতে থাকবে না। এটার দখল থাকবে রাশিয়ার নিজস্ব ডিএনএস কর্তৃপক্ষের হাতে। এতে করে কেউ রাশিয়া থেকে গুগলের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে গেলে তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবেন দেশটির নিজস্ব সার্চইঞ্জিন ইয়ানডেস্কে। একইভাবে ফেসবুকে ঢুকতে গেলে চলে যাবেন রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিকেতে। গত এপ্রিলে এই বিষয়ে সফল পরীক্ষা চালিয়েছে রাশিয়া।
চীনের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় এখনো বাইরে থেকে প্রবেশ করা সম্ভব। কিন্তু চীনা সরকারকে এড়িয়ে তা করা যায় না। চীনারা এই সুযোগটাও আর রাখতে চাইছে না। তাছাড়া চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববাজারে যেসব যন্ত্রপাতি বিক্রি করছে, যেসব নেটওয়ার্ক স্থাপন করছে, সেগুলোকেও নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থায় যুক্ত রাখতে চায় তারা। কিন্তু চীন সতর্ক খেলোয়াড়। তাই তারা সরাসরি নিজেরা এসব উদ্যোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে না। রাশিয়া ও ইরানে ইন্টারনেট নিয়ে যেসব পরীক্ষা চলছে, সেগুলোর মূল কারিগর ও পৃষ্ঠপোষক আসলে চীনারাই। বৈশ্বিক পর্যায়ে রাশিয়া ও ইরান যতটা বিচ্ছিন্ন, চীন ততটা নয়। বরং চীন সারা বিশ্বেই ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করছে। স্প্লিন্টারনেটে তারা সরাসরি অংশগ্রহণ করলে অনেক দেশই এই ভীতির মধ্যে পড়বে যে, চীন হয়তো পরবর্তীকালে ওই ইন্টারনেট ব্যবহারে তাদের বাধ্য করতে চাইবে। এসব বিবেচনা থেকেই চীন কৌশলী পথে হাঁটছে।
স্প্লিন্টারনেট খুব সহজ কোনো ব্যাপার নয়। ইন্টারনেট বিভক্তির পথে বাধা এখনো বহু। রাশিয়া এখন নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা পরিচালনে প্রায় সক্ষম। কিন্তু তবু তারা তা চালু করার পথে হাঁটছে না। এর কারণ হলো, এ মুহূর্তে বিশ্বের সমগ্র ব্যাংকিং খাতের আর্থিক লেনদেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএসভিত্তিক। খুচরা লেনদেনের মাধ্যমগুলোও ওই একই ব্যবস্থায়। চাইলেও নতুন ডিএনএসে এসব প্রতিষ্ঠান রাতারাতি সক্রিয় হতে পারবে না। আবার নতুন ডিএনএসে যোগ দিলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বর্তমান ডিএনএস থেকে সেসব প্রতিষ্ঠানকে বহিষ্কার করে দিতে পারে। ফলে নতুন ইন্টারনেট ব্যবস্থা দাঁড় করানো যতটা পরিশ্রমের, একে কার্যকর ও বর্তমান ইন্টারনেটের বিকল্প বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
কিন্তু চীন এখানেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে এবং ইতোমধ্যে তারা বেশ খানিকটা এগিয়েও গেছে। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির স্থান দখলে অগ্রসর চীন এই মুহূর্তে ৮০টিরও বেশি দেশে টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামোর কাজ করছে। ফাইভ-জি প্রযুক্তিতে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিচ্ছে চীনারাই। এসব দেশের নেটওয়ার্কে চীনা আধিপত্য থাকবে এটা পরিষ্কার। ধারণা করা হচ্ছে রাশিয়ায় পরীক্ষা নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে চীন ইন্টারনেট ব্যবস্থার নতুন সংস্করণ তৈরি করবে।
চীনের নতুন ইন্টারনেটে রাশিয়ার ডিএনএস সিস্টেমকে জায়গা দেয়া হবে। ইরানসহ চীন-রাশিয়াপন্থী দেশগুলোকেও এতে যুক্ত করা হবে। চীনের বৈচিত্র্যময় ও বিশাল অনলাইন বাজারের লেনদেনের অভিজ্ঞতা, ইরানের অর্থনৈতিক অবরোধ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা এবং রাশিয়ার দীর্ঘ প্রযুক্তি নিরাপত্তা বজায় রাখার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাকে এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে। চীন-রাশিয়ার মতো বড় অর্থনীতি ও শক্তি যদি নতুন ইন্টারনেটের সূচনা ঘটায়, তখন বাধ্য হয়ে ছোট অনেক দেশ তাতে অংশ নেবে এবং এটাই ইন্টারনেট বিভক্তিকে পাকাপাকি করে দেবে।
ইন্টারনেট বিভক্ত হলে জনসাধারণের কী হবে
শীর্ষস্থানীয় ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞ জন চিপম্যান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধ ও হুয়াওয়ের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিভক্ত হয়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারনেটের চেয়ে চীনা সংস্করণ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বেশি আকর্ষণীয় হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিখণ্ডিত ইন্টারনেট ব্যবস্থায় প্রত্যেক সেবাদাতা সিস্টেম ব্যবসার দিক থেকে সফল হতে চাইবে। তবে চীনের ইন্টারনেট ব্যবস্থার এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা বেশি। চীনা ব্র্যান্ডগুলো সবচেয়ে সাশ্রয়ী তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য দিয়ে বিশ্বের উদীয়মান দেশগুলোয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। কাজেই বাণিজ্য সম্পর্কে জড়িত দেশগুলোয় নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থার সম্প্রসারণ চীনের জন্য অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় সহজ হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা হারানোর আতঙ্কে আছে। অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিভক্ত হয়ে দুই বা ততোধিক প্রতিযোগী নেটওয়ার্কে পরিণত হলে, তা বৈশ্বিক কানেক্টেড কমিউনিটির জন্য ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না বলে মনে করে ফেসবুক। বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে চলতি সপ্তাহে ফেসবুকের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান নিক ক্লেগ বলেছেন, পরবর্তী মার্কিন সরকারের এক নম্বর ইস্যু হতে হবে ইন্টারনেট ব্যবস্থার বিভক্তি ঠেকানো এবং জোটবদ্ধভাবে উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যবস্থা নেয়া।
দ্বিখণ্ডিত বা স্প্লিন্টারনেট ইন্টারনেট ব্যবস্থায় জনসাধারণকে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে, তা হলো কনটেন্ট সরবরাহ চেইন সম্পূর্ণ বদলে যাবে এবং কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্ট্যান্ডার্ডে। ফলে ইন্টারনেট প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও অন্যান্য ইন্টারনেট অবকাঠামো একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না। অর্থাৎ ভিন্ন ইন্টারনেট স্ট্যান্ডার্ডের জন্য ভিন্ন ইন্টারনেট প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও ইন্টারনেট অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে।
স্প্লিন্টারনেটে নতুন প্রযুক্তি কী হতে পারে পশ্চিমা বিশ্বে সে বিষয়ে এক তোলা গবেষণাও হচ্ছে না। কারণ পশ্চিমারা এই ইন্টারনেটের বিকল্প নিয়ে ভাবছে না, সেরকম কোনো খাতে বিনিয়োগ করছে না। কিন্তু চীন-রাশিয়া তা করেছে। ফলে এক্ষেত্রে তারা কী ধরনের প্রযুক্তি আবিষ্কার ও প্রয়োগ করছে তা অন্যদের অজানা। প্রতিশোধ নিতে চীনারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে বিশেষ প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
ব্যবসার ক্ষেত্রেও মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। কারণ চীন তার ইন্টারনেট চালাবে নিজস্ব আইনে বা নির্দিষ্ট সমঝোতায়। সেখানে তারা তাদে পণ্যকে অগ্রাধিকারের নীতি গ্রহণ করলে বা নিয়ম ভেঙে এরকম কিছু করলে খুব বেশি কিছু করার থাকবে না। বিশেষজ্ঞদের দাবি, অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা সবাই ভোগ করছে। কিন্তু তা বিভক্ত হয়ে গেলে সুযোগ-সুবিধাও বিভক্ত হওয়ার পাশাপাশি সীমাবদ্ধতাও তৈরি হবে বিস্তর।
শেষ কথা
সামরিক লেনদেন ও তথ্য আদান প্রদানে আলাদা ইন্টারনেটের ব্যবহার চলছে অনেক দিন ধরেই। সে হিসাবে স্প্লিন্টারনেট ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তবে রাশিয়া যখন আইন করে নতুন ইন্টারনেটের ঘোষণা দিল, কার্যত তখন থেকেই আমরা ইন্টারনেটের নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। এই যুগ কতটা কঠিন বা সহজ হবে, তার চেয়ে বড় কথা, এটা বাস্তবতা। ইন্টারনেটে পশ্চিমা একচেটিয়া মালিকানাও এক ধরনের হুমকি। স্প্লিন্টারনেটও মানুষের জন্য নতুন অনেক শঙ্কার কারণ।
তবে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এক হিসেবে মানুষের জন্য ভালো। এতে করে অন্তত বিকল্প পরখের সুযোগ থাকে। একপক্ষ অন্যায় করলে আরেক পক্ষকে দেখিয়ে কিছু দর কষাকষি করা যায়। বিশ্ব আরো কঠিন হবে বটে, তবে স্প্লিন্টারনেটও এক ধরনের সম্ভাবনা। কে জানে হয়তো এই ‘রেংলেনের’ মধ্য দিয়েই প্রযুক্তিবিশ্ব তার স্থিতিশীলতা খুঁজে পাবে।
সূত্র: বিবিসি, তাস, সিএনবিসি, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ফার্স নিউজ, নিউইয়র্ক টাইমস।
লেখক : জার্মান প্রবাসী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
আপনার মতামত জানানঃ