সম্প্রতি দেশে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব অপরাধ ও অপকর্মের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা ও ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এমনকি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মতো ঘৃণ্য অপরাধও আছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার ভলাকুট ইউনিয়নের দূর্গাপুর গ্রামে এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া এক শিশুর মরদেহ দাফনে বাধা দিয়ে ‘চাঁদা’ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। চাতলপাড় তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ (আইসি) কাঞ্চন কুমার সিংহের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে।
বৃহস্পতিবার (০৭ এপ্রিল) উপজেলার ভলাকুট ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।
এর আগে ভলাকুট ইউনিয়নের কান্দি গ্রামেও এমন আরো একটি অভিযোগ রয়েছে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
মৃত শিশুর পরিবারের সদস্যরা জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে দুর্গাপুর গ্রামে আরিফা আক্তার নামে ১৫ মাস বয়সী এক শিশু বাড়ির পাশের ডোবার পানিতে ডুবে মারা যায়। বিষয়টি পুলিশকে না জানিয়ে মরদেহ দাফনের প্রস্তুতি নেয় শিশুটির পরিবার। তবে স্থানীয়দের কাছ থেকে শিশুর মৃত্যুর খবর পেয়ে নাসিরনগর থানার চাতলপাড় ফাঁড়ির ইনচার্জ কাঞ্চন কুমার সিংহ বাড়িতে গিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ দাফন করা যাবে না বলে জানান। পরে টাকা দেওয়ার পর মরদেহ দাফনের অনুমতি দেন তিনি।
নিহত আরিফার চাচা মো. বোরহান মিয়া অভিযোগ করে বলেন, বাজার থেকে কাফনের কাপড় নিয়ে এসে দেখি বাড়িতে পাঁচজন পুলিশ। তারা লাশের ময়নাতদন্ত করতে বলেন। তখন আমরা আমাদের সন্তান পানিতে ডুবে মারা গেছে। আমাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও নেই বলে জানাই।
পরে কাঞ্চন কুমার সিংহের কাছে জানতে চাই তাহলে কেন লাশের ময়নাতদন্ত করতে হবে? এর উত্তরে তিনি বলেন, লাশের ময়নাতদন্ত করতে ২০ হাজার টাকা লাগে। আমাদের ১৫ হাজার টাকা দিয়ে দাও তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না। সাবেক ইউপি সদস্য শাফি মাহমুদ ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিততে কাঞ্চন কুমার সিংহের হাতে ৮ হাজার টাকা তুলে দিই।
শাফি মাহমুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশে টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমি জানার পর কাঞ্চন কুমার সিংহকে ফোন করে বলি, পরিবারটি খুবই গরিব। আপনারা তো বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক টাকা কামান। এদের টাকাটা ফেরত দিয়ে দেন। তখন ওই কর্মকর্তা টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেন।
তা ছাড়াও উক্ত ইউনিয়নের কান্দি গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ও নিহতের মামা মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, তার বোনজামাই গ্রামের মাসুক মিয়ার ছেলে মো. কালু মিয়া (৪) গত শবে বরাতের দিন বাড়ির পাশে নদীর পানিতে ডুবে মারা যায়।
স্থানীয়দের কাছ থেকে শিশুর মৃত্যুর খবর পেয়ে নাসিরনগর থানার চাতলপাড় ফাঁড়ির ইনচার্জ কাঞ্চন কুমার সিংহ বাড়িতে গিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ দাফন করা যাবে না বলে জানান। পরে টাকা দেওয়ার পর মরদেহ দাফনের অনুমতি দেন তিনি।
খবর পেয়ে আইসি কাঞ্চন কুমার সিংহ পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। নিহতের পরিবারের কারো কোনো অভিযোগ না থাকলেও তিনি লাশ দাফনে বাধা দেন। পরে গ্রামের চৌকিদার ধন মিয়াকে দিয়ে এক রাত একদিন লাশ পাহারার ব্যবস্থা করেন। এ জন্য চৌকিদার ধন মিয়াকে দিতে হয় এক হাজার টাকা ও আইসি কাঞ্চন কুমারকে দিতে হয় ৩২ হাজার টাকা। কাঞ্চন কুমার সিংহ ৩২ হাজার টাকা পাবার পর লাশ দাফনের অনুমতি দেন।
অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা আইসি কাঞ্চন কুমার সিংহের দাবি, লাশের সুরতহাল রিপোর্টের কাগজ নাসিরনগর সদরে পাঠাতে নৌকা ভাড়া বাবদ এক হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। ৮ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগটি মিথ্যা বলে দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।
সরাইল, নাসিরনগর, আশুগঞ্জের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, মো. আনিসুর রহমান বলেন, যদি টাকা নেওয়ার বিষয়টি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এটি পুলিশের জন্য লজ্জাজনক। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৩
আপনার মতামত জানানঃ